থ্রি জিরো তত্ত্ব
টেকসই উন্নয়নের নতুন দিগন্ত
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী ধারণা, যা বর্তমান বিশ্বে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণের মতো প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জের সমাধান করতে পারে। সম্প্রতি সরকারের এসডিজি কার্যক্রমে এই তত্ত্ব অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ এক ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা বহন করছে। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে।
‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’ শুধু একটি তাত্ত্বিক মডেল নয়; এটি বাস্তবসম্মত এক রূপরেখা, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই মডেলের তিনটি স্তম্ভ- শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ- বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ড. ইউনূস তার এই তত্ত্বে তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, তরুণ প্রজন্ম তাদের উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব দিতে পারে। ‘আমরা জন্মেছি সমস্যা সমাধানের জন্য, কারো অধীনে চাকরি করার জন্য নয়’- তার এই বক্তব্য নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে যথেষ্ট। তবে, এই তত্ত্বের বাংলাদেশে বাস্তবায়ন এখনো কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাজনৈতিক প্রতিকূলতা এবং সচেতনতার অভাব এর প্রসারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে ‘থ্রি জিরো ক্লাব’ গড়ে তোলা ছিল বেশ কঠিন। তবে বর্তমান পরিবেশে এই ক্লাবের প্রসার এবং সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছে, যা একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
লামিয়া মোরশেদের নেতৃত্বে ‘থ্রি জিরো ক্লাব’ এবং সামাজিক ব্যবসার বিস্তার একটি অনন্য উদ্যোগ। এই ক্লাব তরুণদের নিজেদের উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার সুযোগ করে দিচ্ছে। বিশেষ করে, তরুণদের ‘থ্রি জিরো পারসন’ হিসেবে গড়ে তোলার এই ধারণা দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং পরিবেশগত সমস্যার টেকসই সমাধান দিতে পারে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে থ্রি জিরো ক্লাব গড়ে উঠলেও বাংলাদেশে এই ক্লাবের প্রসার তুলনামূলকভাবে কম। তবে সাম্প্রতিককালে এই ধারণাটি ব্যাপক আলোচনায় আসায় নতুন উদ্যোগ গতি পাচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’ এক নতুন সভ্যতার স্বপ্ন দেখায়। এটি শুধু টেকসই উন্নয়নের একটি ধারণা নয়, বরং একটি বৈপ্লবিক রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি। এটি দারিদ্র্যমুক্ত, বেকারত্বমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব এক নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার হাতিয়ার হতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এই তত্ত্বের সঠিক প্রয়োগ হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় এক নবযুগের সূচনা হবে। সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে, এর টেকসই বাস্তবায়নের জন্য সরকার, প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু সরকারি প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়; ব্যক্তি ও সমাজকেও এই তত্ত্ব গ্রহণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে ‘থ্রি জিরো পারসন’ হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করতে হবে, যারা নিজের উন্নতির সঙ্গে সমাজের সমস্যাগুলো সমাধানে ভূমিকা রাখবে। এই তত্ত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের জন্য উন্নয়নের একটি মডেল হয়ে উঠতে পারে।
‘থ্রি জিরো’ আমাদের সামনে এক নতুন স্বপ্নের দুয়ার খুলে দিয়েছে। এটি শুধু একটি উন্নয়ন মডেল নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এক আশার আলো। দারিদ্র্যমুক্ত, বেকারত্বমুক্ত ও কার্বন নিঃসরণমুক্ত এক নতুন পৃথিবী গড়ার এই যাত্রায় সবাইকে অংশীদার হতে হবে।
"