তুহিন চাকমা

  ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

মুক্তমত

শিক্ষাসংকট উত্তরণে এখনই পদক্ষেপ প্রয়োজন

শিক্ষা হলো একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি। বলা হয়ে থাকে, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। তাই শিক্ষার উন্নতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় বিশ্বের প্রায় সব দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত ও বৈষম্যমূলক খাত হলো শিক্ষা। যার ফলে দেশের কাঙ্ক্ষিত ও সার্বিক উন্নতিতে তেমন কোনো গতি নেই। বর্তমানে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এবং কাঠামোগত বৈষম্য শিক্ষা খাতকে গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়েছে। উপরন্তু, শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা, আর্থিক সুবিধা এবং সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বড় দুর্বলতা। এই সংকট মোকাবিলায় শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মোটাদাগে দুটি ধারায় বিন্যস্ত। একটি হলো সাধারণ শিক্ষা এবং সমাজ পরিচালিত স্বতন্ত্র মাদরাসা শিক্ষা। তিনস্তরের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কোনো পর্যায়ের শিক্ষার অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যেই শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাকে এখন জ্ঞানচর্চার বিষয় হিসেবে মনে না করে ব্যবসায়িক বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। যার যত টাকা, সে তত বেশি উচ্চতর ডিগ্রি ও গুণগত শিক্ষা পাবে। যার ফলে প্রকৃত শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও নীতিনৈতিকতা বলে কোনো কিছুই আর থাকছে না, থাকছে শুধু লাভ-লোকসানের হিসাব। অন্যদিকে, সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হলেও বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও প্রাথমিক স্তরের অবকাঠামো এখনো দুর্বল। শহর ও গ্রামীণ এলাকায় পর্যাপ্ত বিদ্যালয় থাকলেও নেই দক্ষ এবং পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক। শিক্ষকদের বেতনকাঠামো সন্তোষজনক না হওয়ায় মেধাবীরা পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিতে আগ্রহী নন। অনেক প্রান্তিক অঞ্চলে শিক্ষক ঘাটতি প্রকট। বিশেষ করে এমপিওভুক্তির বাইরে থাকা বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা বেতনবৈষম্যের শিকার। শিক্ষকদের মধ্যে পেশাদারির অভাব এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতাও শিক্ষার মান কমিয়ে দিচ্ছে। এদিকে, পথশিশু এবং দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য শিক্ষার সুযোগ এখনো সীমিত।

এ পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য বাংলাদেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল ও বৈপ্লবিক সংস্কার দরকার। প্রথমত, শিক্ষার উদ্দেশ্য পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে হবে। শিক্ষাকে শুধু পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন না করে, শিক্ষার্থীর নৈতিক, সামাজিক এবং সৃজনশীল দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যক্রম আধুনিক ও বাস্তবমুখী করতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু চাকরি জন্য নয়, বরং সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের আর্থিক ও পেশাগত সম্মান নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ কমিয়ে আনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি, শিক্ষা যেন সব শ্রেণির মানুষের জন্য সহজলভ্য হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

সর্বোপরি, একটি ন্যায়সংগত ও গুণগত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে এবং এর পদ্ধতি যুগোপযোগী করতে হবে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের আরো পাঁচটি সেক্টরে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এ নিয়ে ১১টি সেক্টরের সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। আমি মনে করি, শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনে বিলম্ব করা উচিত নয়। যেহেতু সংস্কার একটি চলমান ও দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া, তাই কাজটি আমাদের এখনই শুরু করতে হবে। যদি আমরা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মতামত নিয়ে টেকসই ও কার্যকর পরিকল্পনা হাতে নিতে পারি, তবে আমরা বিশ্ব-দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।

লেখক : শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close