এম এ মাসুদ
মুক্তমত
শিশুর প্রতি সহিংসতা যেন অন্ধকার যুগের পুনরাবৃত্তি
জাহিলিয়াতের যুগে শিক্ষায় ঘাটতি থাকায় পুত্রসন্তানের বাবা হলে পুরুষরা নিজেকে বীর এবং কন্যাসন্তানের বাবা হলে অপমানিত বোধ করতেন। আর এ অপমান থেকে মুক্ত হতে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর পর্যন্ত দিতে দ্বিধা করতেন না বর্বর বাবা। এমন পৈশাচিক ঘটনায় অনুশোচনা তো দূরের কথা, বরং তা বৈধ বলেই মনে করতেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বনি তামিম গোত্রের প্রধান কায়েস বিন আসেমের একটি করুণ ঘটনা আছে। একদা নবী করিম (সা.)-এর দরবারে বসে কীভাবে স্বীয় জীবিত কন্যাসন্তানকে মাটিচাপা দিয়ে হত্যা করেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। বললেন, ‘হে আল্লাহর নবী, আমি আরবের বুকে কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া দলের প্রধান। আমার স্ত্রী আমার অজান্তে একটি কন্যাসন্তানকে লালনপালন করছিলেন। ১০-১২ বছর বয়সে তা আমার চোখে পড়ে। কন্যার রূপলাবণ্যে আমিও পিতৃস্নেহে বিমোহিত হলাম। কিন্তু কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়ার নীতি আমাকে স্থির থাকতে দিল না। এক দিন মিথ্যে ছলনায় স্ত্রীকে বললাম, ‘মেয়েকে বেড়াতে নিয়ে যাব। ওকে সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজিয়ে দাও।’ বেড়াতে যাব বলে তাকে নিয়ে মরুপথে চললাম। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গর্ত খোঁড়া শুরু করলাম। গর্ত থেকে মাটি তুলে মেয়ে আমাকে সাহায্য করছিল। হায়! সে তখনো জানতে পারেনি যে নিজের কবর সে নিজেই খুঁড়ছে। মাটি এসে আমার দাড়িতে লাগছিল আর মেয়েটি তা ঝেড়ে দিচ্ছিল। অবশেষে গর্ত খোঁড়া শেষ হলে আমি মেয়েটির হাত ও পা বাঁধতে শুরু করলাম। মেরে ফেলব ভেবে সে কেঁদে কেঁদে বলেছিল, ‘আব্বা, আমি আপনাকে আর বাবা বলে কারো কাছে পরিচয় দেব না। আমাকে মেরে ফেলবেন না আব্বা।’ আমি তার কথায় কান না দিয়ে তাকে নির্মমভাবে গর্তের মধ্যে ফেলে দিলাম। তারপর তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য একটি বড় পাথর তার বুক বরাবর ছুড়ে মারলাম। রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছিল। আর তার সর্বশেষ আর্তনাদ শুনতে পেলাম, ‘হে আব্বা!’
বর্ণনা শুনে নবী করিম (সা.)-এর দুচোখে অশ্রুধারা বয়ে চলছিল এবং তার দাড়ি মোবারক ভিজে গিয়েছিল। ইসলামের আবির্ভাবে আইয়ামে জাহিলিয়ার ঘৃণিত এ রীতি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘জীবন্ত প্রোথিত কন্যাসন্তানকে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে কোন অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল।’ (সুরা : আত-তাকবির)
কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সামাজিক এ সমস্যার শুধু রূপ বা ধরন পরিবর্তন হয়েছে বটে, কিন্তু একেবারে দূর হয়েছে এমনটি বলা যায় না। বর্বর ওই যুগে লেখাপড়ার তেমন একটা বালাই না থাকলেও বর্তমান যুগে তো সেই ঘাটতি নেই! কিন্তু তবুও থামছে না অন্ধকার যুগের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার পুনরাবৃত্তি। গত ৯ জুলাই পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ বহনের সক্ষমতা না থাকায় ১৫ দিন বয়সি মেয়েকে জীবন্ত দাফন করে দিয়েছেন এক বাবা!
এ ছাড়া দেশে বিভিন্ন সময়ে কন্যাসন্তানকে পানিতে ফেলে দিয়ে হত্যা করছেন মা। ঘটছে কন্যা-ভ্রূণ নষ্ট করার মতো ঘটনা। নিউন্যাটাল শিশুদের ফেলে দেওয়া হচ্ছে ডাস্টবিনে- এমন শিরোনামগুলো হামেশাই আসছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। প্রকাশিত এ সংবাদগুলো যেন আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের সেই অন্ধকার যুগে ফিরে যাওয়ার কথা।
মানুষের মৃত্যুর মধ্যে মূলত প্রথম শিকার হচ্ছে শিশুরা। জন্মের পর দৈহিক ত্রুটি, মাতা-পিতার অবহেলা, বিভিন্ন রোগব্যাধি, অপুষ্টিতে মৃত্যু হচ্ছে শিশুর। পাশাপাশি শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, বলাৎকারসহ সমাজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায় ঘটছে শিশুমৃত্যু।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, চলতি বছর গত ১০ মাসে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, সহিংসতার কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয় ৪৮২ জন শিশু। ধর্ষণের শিকার হয় ২১৭ জন শিশু, ১৫ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়, ধর্ষণচেষ্টার শিকার ৬১ ও যৌন হয়রানির শিকার হয় ৩৪ জন শিশু। যার মধ্যে শিক্ষক দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮৫ জন এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৩২ ছেলেশিশু। শিক্ষক কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩৯ জন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে ১২১ জন শিশু। ২০২৩ সালের প্রথম ১০ মাসে যা ছিল ৪২১ জন।
শিশুদের এমন অনিরাপত্তা ও প্রাণহানি প্রভাবিত করতে পারে জন্মহারকে। বাড়িয়ে দিতে পারে জনসংখ্যা। ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে আয়, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং নিয়োগের ওপর। সুতরাং সামাজিক এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে পরিবারে বাড়াতে হবে নৈতিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা। শিশু নিপীড়কদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন। কন্যা-ভ্রূণ হত্যা বন্ধে নিতে হবে যৌতুকবিরোধী কঠোর অবস্থান। এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, শিশু অধিকারভিত্তিক সংগঠন, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষসহ সমাজের সবপর্যায়ের অংশীজনদের। তাহলে অকালমৃত্যু থেকে রক্ষা পাবে শিশুরা। কমবে জন্মহার। উন্নতি হবে দেশ ও জাতির।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
"