সোহান ফরাজী
দৃষ্টিপাত
অনাথ ও পথশিশুদের যথাযথ আবাসন প্রয়োজন
আমরা মানুষ, সমস্যার ঊর্ধ্বে কেউ না। প্রতিনিয়ত সমস্যার সংখ্যা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। হাজার হাজার সমস্যার মধ্যে অনেক বড় একটি সমস্যা অনাথ ও পথশিশুদের অপরিকল্পিত ও দুর্বিষহ জীবন। যার কারণে তারা মারাত্মক দুটি সমস্যার মধ্যে হরহামেশা জড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে একটি ভিক্ষাবৃত্তি ও মাদকাসক্তি।
জগতের প্রতিপালক সৃষ্টিকর্তার পর স্নেহময়ী মাতা-পিতার স্থান। মাতার স্বার্থহীন ভালোবাসা, আদর, স্নেহ-মমতার পরশে একটি শিশু ধীরে ধীরে বড় হয়। পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের নিয়ে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখেন। তারা তাদের সামর্থ্যরে চেয়েও অনেক বেশি বাজেট রাখেন সন্তানদের জন্য। সব পিতা-মাতার চাওয়া- তাদের বুকের ধন, আদরের সন্তান বড় হয়ে সমাজের একজন বিশেষ ব্যক্তি হবে। তবে যে পিতা-মাতার সামর্থ্য নেই, অথবা যে সন্তানদের কপালে জোটেনি মায়ের শাড়ির আঁচলে মুখ লুকানো স্বর্গীয় সুখ, বাবার অপার স্নেহ, ভালোবাসা; এমনকি যে সন্তানদের জীবন দারিদ্র্যের আগুন-খাঁচায় বন্দি, তাদের অবস্থা করুণ। যাদের পিতা-মাতা নেই তাদের অবস্থা কল্পনার বাইরে।
শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্য আজকের অনেক শিশু দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হয়েও বাল্যজীবনকে হত্যা করে চলছে অনিশ্চিত গন্তব্যে। এই শিশুগুলো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে চারিত্রিক গুণাবলির চর্চা, উপযুক্ত নৈতিক শিক্ষা ও আচার-আচরণ, শিশুসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব, কথাবার্তার শালীনতা, সততা, বিশ্বাস, সুবিবেচনা, সাধারণ জ্ঞান, ধ্যান-ধারণা, বুদ্ধির উন্মেষ ঘটানো ইত্যাদি থেকেও বঞ্চিত।
শুধু ঢাকা শহরেই ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এর মধ্যে ২০ শতাংশই শিশু। প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকার ভিক্ষাবাণিজ্য হয় এখানে। সেই হিসাবে মাসে ৬০০ কোটি টাকা। এ বিশাল অঙ্কের অর্থ নিয়ন্ত্রণের আড়ালে অবশ্যই কোনো শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাত আছে এবং নিশ্চয়ই অনেক লম্বা সেই হাত। হিংস্র, অমানবিক ও পাশবিক এ বাণিজ্য নির্মূলে আজ পর্যন্ত সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
শিশু ভিক্ষাবৃত্তির আড়ালে রয়েছে দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, কর্মহীনতা, কর্মবিমুখতা, অশিক্ষা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা। জাতীয় শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ শিশু আইন-২০১৩ পাস করা হয়েছিল। কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ নেই, বিশেষ করে শিশু ভিক্ষাবৃত্তির বিরুদ্ধে।
মাদক এক অভিশাপের নাম, এক সর্বনাশের নাম। এটি এমন একটি সামাজিক সমস্যা, যা শুধু অপরাধের জন্ম ও বিকাশ করে না, বরং এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর এটা এমনই এক বিষ, যা ধীরে ধীরে বিবর্ণ করে দিচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্মকে। নষ্ট করে দিচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ। ভয়াবহ মাদক ড্যান্ডির মারাত্মক ছোবলে আগামীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নয়, এখন মাদক নিতে দেখা যায় পথশিশুদেরও। তাদের নেতিবাচক পারিপার্শ্বিকতা মাদককে করেছে এই অবহেলিত শিশুদের জন্য সহজলভ্য। এখনই সচেতন না হলে এর ভয়াবহতায় সমাজ হবে কলুষিত।
রাজধানীর গুলিস্তান, খিলগাঁও, কমলাপুর, মালিবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা এলাকাসহ অলিগলিতে এবং বস্তির অনেক জায়গাতেই পথশিশুদের নেশা করতে দেখা যায়। পথশিশুদের কেউ কেউ দিনের বেলা নেশা করলেও বেশির ভাগই নেশা করে রাতে। কেউ একা, আবার কেউ কেউ গোল হয়ে বসে সংঘবদ্ধ হয়ে নেশা করে। পলিথিন, প্লাস্টিক ছাড়াও নিজের পরিধেয় জামায় ড্যান্ডি গাম লাগিয়ে নেশা করে তারা। কিছুক্ষণ পরপর ঘ্রাণ নিয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে যায় সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুরা। বাবা-মাহীন ভবঘুরে জীবনযাপন তাদের। কারোবা বাবা-মা আছে, কারো বা নেই। কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিক, লোহা, কিংবা পুরোনো জিনিস বিক্রি করে পেট চালায় তারা। ঘাড়ে চটের বস্তা নিয়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ঘুরে বেড়ায় এসব পথশিশু। সারা দিনের সংগৃহীত ভাঙারি বিক্রি করে যে আয় হয়, তা দিয়ে একবেলা খাবার কিনে খায় আর বাকি দুবেলাই নেশা করে তারা। নেশার এই উপকরণটি ‘ড্যান্ডি’ নামেই বেশি পরিচিত। সর্বনাশা এই মাদকের ছোবলে যুবক ও বয়স্কদের পাশাপাশি ‘ড্যান্ডি’ নেশায় এখন পথশিশুরাও আসক্ত। ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জীবনে। এসব শিশুর বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, যাদের বয়স ৮ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। প্রথম প্রথম ঘ্রাণটা ভালো না লাগলেও পরে ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। একবার ড্যান্ডির ঘ্রাণ নিলে সারা দিন মাথা ঝিমঝিম করে, কারণ এটা মস্তিষ্কে গিয়ে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ফলে তাদের ভেতরে এক ধরনের সুখের অনুভূতি তৈরি হয়। এই অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু পরবর্তী সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। এই ঘ্রাণ শরীরের যেসব জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়, সেসব জায়গার কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। আর কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের কাজে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এ ছাড়া নাকের ভেতরে ঘা হয়ে যায়। এ ধরনের মাদকে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। শিশুরা যেহেতু এটা গ্রহণ করে, ফলে এর প্রতিক্রিয়া হয় ভয়াবহ।
বর্তমানে পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই এখন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে। এসব জায়গায় ৯-১৮ বছর বয়সি শিশুরা মাদক সেবন করে। দেশে মাদক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানুষ নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। পথশিশুদের কাছে মাদক বিক্রির জন্য একটা সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করে। ভাঙারি ক্রেতারাই শিশুদের কাছ থেকে ভাঙারি কিনে নেয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের হাতে মাদক তুলে দেয়। পথশিশুদের মধ্যে শৈশবে নানা পারিবারিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি প্রভৃতির শিকার হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া শিশুদের সংখ্যাই বেশি। তাদের বেশির ভাগই বিপথে থাকা বড়দের কবলে পড়ে মাদকাসক্ত হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের সর্বশেষ আদমশুমারিতে ভাসমান মানুষের সম্পর্কে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, দেশে চার লাখের মতো পথশিশু রয়েছে, যার অর্ধেকই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকায়। মাদকের চোরাচালান, বাজারজাত ও সামগ্রিক বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশু-কিশোররাও। পথশিশুদের কাছে মাদক হিসেবে আকর্ষণীয় প্রাণঘাতী নেশা ড্যান্ডি দেশের যুবসমাজ থেকে শুরু করে নারী-শিশুরাও আজ মাদকের জন্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার। অথচ আগামী দিনের কর্ণধারদের এভাবে সমূলে ধ্বংস করে দিচ্ছে ভয়াবহ মাদক।
আমাদের আগামী প্রজন্মের প্রত্যয়দীপ্ত পতাকার ধারক ও বাহক শিশুরাই। তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের জাতীয় চেতনা ও অঙ্গীকারের প্রতিশ্রুতি। তাদের গড়ে তোলার জন্য যা কিছু করণী,য় তার সবই আমাদের জাতীয়, সামাজিক ও পারিবারিক কর্তব্যের মূল শর্ত। এ শিশুরাই আমাদের আগামী পৃথিবী ও পরিচিতি। ফুলে ফুলে বিকশিত হোক তাদের ভবিষ্যৎ- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
"