জলবায়ু সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস
সংকট মোকাবিলায় নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন
ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ শুরু হয়, যা বাতাসের উষ্ণতা ও বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু গত এক শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলবায়ুর এই পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে যাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে একবিংশ শতাব্দী শেষে বিশ্ব থেকে অন্তত ৪৩টি দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে হারিয়ে যাবে! বাংলাদেশেরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ডুবে যেতে পারে। অথচ যেসব দেশ এজন্য দায়ী, তারা এখনো নির্বিকার।
পরিসংখ্যানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও রাশিয়া পৃথিবীব্যাপী ৫৫ শতাংশের বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে। অন্যদিকে, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর দায় একেবারেই নগণ্য। বাংলাদেশের দায় এ ক্ষেত্রে মাত্র ০.৪৭ ভাগেরও কম। তারপরও বাংলাদেশকে এর ক্ষতিকর প্রভাব কঠিনভাবে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ুতে মানুষের সৃষ্টি ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ১৫৪টি দেশ ১৯৯২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। এরপর থেকে জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন (কপ) প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়। এবার বাংলাদেশ এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে আমূল বদলে যাওয়া এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য অভিযোজন, প্রশমন এবং ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি অর্থায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। ১১ নভেম্বর আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে শুরু হয়েছে কপের ২৯তম সম্মেলন। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসসহ বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ১৩ নভেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রদত্ত ভাষণে নতুন একটি পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি জলবায়ু সংকটকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপস্থাপন করতে চাই। এই দৃষ্টিভঙ্গি জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলার পাশাপাশি আরো হানিকর পরিস্থিতির দিকে যাওয়া ঠেকাবে। এটা অনেক বড় কাজ এবং বড় প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। তিন শূন্যের নতুন পৃথিবী গড়ার ব্যাপারে আমার দীর্ঘদিনের যেই স্বপ্ন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে চাই। জলবায়ু সংকট আরো গভীর হচ্ছে। আমাদের সভ্যতা এক বড় ঝুঁকির মধ্যে। কারণ আমরা অব্যাহতভাবে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে, এমন মূল্যবোধই লালন করছি। একটি নতুন সভ্যতার ভিত গড়তে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা, অর্থনৈতিক ও তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, যাতে আমরা নিজেদের সুরক্ষা দেয় ও নিজেদের উদ্দীপ্ত করে এমন সভ্যতা গড়তে পারি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা, এই পৃথিবীর অধিবাসীরাই পৃথিবী ধ্বংসের কারণ। আমরা জেনেশুনে এই ধ্বংস প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এমন এক জীবনধারা বেছে নিয়েছি, যা পরিবেশের বিপরীতে কাজ করছে।’ আমরা বিশ্বাস করি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই আহ্বান সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববাসীকে নতুন পথ দেখাবে। সঙ্গে সঙ্গে উজ্জীবিত হবে এ দেশের মানুষও। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সে হিসেবে কপ-২৯-এ বাংলাদেশ জলবায়ু-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ, উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনে বৈশ্বিক পদক্ষেপের হকদারও বটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতি নিরূপণ করার জন্য একটি ক্লাইমেট ভালনারিবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, বার্ষিক বর্ষা ও বন্যা বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১৮ শতাংশ প্রভাবিত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ ঘটনাগুলো তীব্র হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। ফলে, মিঠাপানির সম্পদ এবং আবাদযোগ্য জমি দূষিত হচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ।
বলা সংগত, সে ক্ষেত্রে কপ-২৯ সম্মেলন বাংলাদেশকে সহজলভ্য এবং পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়নের জন্য দর-কষাকষির একটি উপযুক্ত প্ল্যাটফরম। তাই তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে মানুষকে বাঁচানো এবং তাদের সংকট মোচনের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি অর্থায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির জন্য কপ এবং সংশ্লিষ্ট সব ফোরামে আরো সোচ্চার হতে হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
"