সৈয়দা ফারিভা আখতার

  ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

মুক্তমত

হেমন্তের স্নিগ্ধতায় নবান্নের সুরভি

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বাংলার এই ঋতুচক্রের একটি বিশেষ সময় হলো হেমন্ত, যা শুরু হয় শরতের শেষ দিয়ে। সাধারণত কার্তিক মাসের শুরুতে হেমন্ত ঋতুর শুরু হয়। বাংলার ঋতুচক্রে হেমন্তের আগমন এক বিশেষ পরিবর্তন নিয়ে আসে, যা বছরের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় এবং আনন্দময় একটি অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের একটি বিশেষ উৎসব হলো নবান্ন উৎসব। বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দময় একটি অনুষ্ঠান হলো নবান্ন উৎসব। নবান্ন উৎসব হলো বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী কৃষি উৎসব, যা নতুন ফসল ঘরে তোলার পর পালন করা হয়। কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমের ফলে নতুন ধানের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে এই নবান্ন উৎসব। এই উৎসবটি কৃষকের পরিশ্রম এবং মাটির সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্কের প্রতিফলন হিসেবে কাজ করে।

নবান্ন উৎসব শুধু একটি কৃষি অনুষ্ঠানই নয় বরং এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সমাজের অন্তর্নিহিত সম্পর্কের প্রতীক। নবান্ন উৎসব বাংলার কৃষক সমাজের একটি প্রাণবন্ত উৎসব। নবান্ন উৎসবের সূচনা হয় গৃহস্থদের বাড়িতে নতুন ধান ভাঙার মাধ্যমে। অর্থাৎ এ সময় কৃষকরা তাদের শ্রমের ফল হিসেবে নতুন ধানকে স্বাগত জানায়। বাড়ির সব সদস্য মিলে ধান ভাঙার কাজ করেন। এমনকি বিভিন্ন বাড়িতে সবাই মিলে একত্র হয়ে নতুন ধান সংগ্রহ করার পর বিভিন্ন ধরনের পিঠে যেমন- নতুন চালের ভাত, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, নাড়ু, পাটিসাপটা পিঠাসহ অন্যান্য মুখরোচক খাবার তৈরি করে। যার ফলে পরিবারের মধ্যে ঐক্য এবং সহযোগিতার প্রতীকও লক্ষ করা যায়।

নবান্নের আনন্দ শুধু যে খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়, বরং গ্রামে গ্রামে এ সময় নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন- গানের তালে তালে নাচ, লোকগীতি, লাঠিখেলা, পুতুলনাচ, নৃত্য ও নাটক পরিবেশন, ইত্যাদি আরো অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, যা এই উৎসবের আনন্দকে আরো দ্বিগুণ করে দেয়। এমনকি বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে এ সময় মেলারও আয়োজন করা হয়ে থাকে, যেখানে স্থানীয় কৃষকরা তাদের নতুন ফসল, স্থানীয় হস্তশিল্প, খাবার ও কৃষিপণ্যও বিক্রি করে। এই মেলা শুধু বেচাকেনার ক্ষেত্রই নয়, বরং এটি একটি সামাজিক মিলনমেলা। যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একত্র হয় এবং নিজেদের আনন্দ ভাগাভাগি করে। এ ছাড়া এই নবান্ন উৎসবের সঙ্গে হালখাতার উৎসবও পালিত হয়ে থাকে। যেখানে ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করে। এই হালখাতার সময় মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে তারা নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানায়। যার ফলে সম্পর্ক মজবুত হয়। এই নবান্ন উৎসব শুধু শুধু খাদ্য বা কৃষির উদযাপনই নয় বরং এটি বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক গৌরবের একটি উৎসব। যার ফলে বাঙালিদের মধ্যে মধুর বন্ধন তৈরি হয়। নবান্ন উৎসব সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করে। যেখানে প্রতিবেশীরা একত্র হয়, আনন্দ ভাগাভাগি করে এবং কৃষকের সাফল্য উদযাপন করে। এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি অঙ্গ, যা নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করায়। কিন্তু এই উৎসবের গুরুত্ব কি শুধু গ্রামীণ সমাজেই সীমাবদ্ধ?

গ্রামাঞ্চলে নবান্ন উৎসবের যেমন কদর আছে, তেমন কদর শহরাঞ্চলে নেই বললেই চলে। গ্রামীণ সমাজে যেখানে এই উৎসবটি সজীব ও আনন্দময়ভাবে পালিত হয়, সেখানে শহুরে সমাজে এর গুরুত্ব ও গভীরতা অনেকটাই ক্ষীণ। শহুরে সমাজে নবান্ন উৎসবের গুরুত্ব অনেকটাই কম। শহরের জীবনযাত্রা এতটাই দ্রুতগতির, সেখানে কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত উৎসবগুলো আজ প্রায় বিলুপ্ত। এমনকি শহরের প্রায় অনেকেই জানে না যে নবান্ন উৎসব কীভাবে উদযাপন করতে হয়, কারণ তাদের জীবন কৃষি থেকে বিচ্ছিন্ন। শহরের মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয়, যার ফলে নবান্ন উৎসব তাদের কাছে একটি স্থানীয় সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শহরে নবান্ন উৎসবে বিশেষ খাবার বা নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়, তবে এর গভীরতা এবং সাংস্কৃতিক অনুভূতি অনেকটাই কম। নবান্ন উৎসবের মূল উদ্দেশ্যই হলো নতুন ফসলের আগমন ও পুরোনো ফসলের কৃতজ্ঞতা। তবে, শহরের জন্য এটি একটি ফুরসত কাটানোর উপলক্ষ হলেও গ্রামীণ সমাজে এই উৎসব অন্তর্নিহিত অর্থে এখনো অপরিবর্তিত আছে। কিন্তু নবান্ন উৎসবের অর্থ ও মূল্যায়ন যদি শহর ও গ্রাম উভয়ের জন্য পুনর্বিবেচনা করা হয়, তবে এটি একটি সুন্দর সেতুবন্ধ তৈরি করতে পারে। শহরের মানুষ যদি গ্রামের নবান্ন উৎসবের প্রকৃত রূপ ও ঐতিহ্যকে বোঝে, তাহলে তারা হয়তো আরো গভীরভাবে তা উপভোগ করতে পারবে।

নবান্ন উৎসব শুধু নতুন শস্যের আগমনের উল্লাস নয়, বরং এটি বাংলার কৃষি ও সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ। এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা কৃষকের শ্রমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং নতুন সম্ভাবনার দিকে নজর দিই। এটি আমাদের এবং আমাদের সমাজের বন্ধনকে দৃঢ় করে। এমনকি আনন্দ ভাগাভাগির একটি উপলক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে। এ ছাড়া নতুন শস্যের প্রতীক হিসেবে নবান্নের নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন এবং নতুন উদ্যোগের বার্তা নিয়ে আসে। তাই এ উৎসব আমাদের কৃষকদের শ্রম, সংগ্রাম এবং সাফল্যের প্রতীক। এই উৎসব আমাদের একত্র করে নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তাই বাংলার জমিনে এই নবান্ন উৎসব আমাদের সামগ্রিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

লেখক : শিক্ষার্থী, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close