মো. সাইফুল ইসলাম

  ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বিদায় হোক

ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ববঙ্গের অগ্রগতির সম্ভাবনা বিনষ্টে এ অঞ্চলের মুসলমানদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রশমিত করতে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে নাথান কমিশন। একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত (বঙ্গভঙ্গ) বাতিলে বৃহৎ একটি গোষ্ঠীর সংঘটিত ক্ষতি পুষিয়ে দিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত একটি রাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব তথা সর্বজনীন ভূমিকার কথা জানান দেয়।

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববঙ্গের এই সর্বোচ্চ বাতিঘর তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বিকশিত হয় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যারা পাশ্চাত্য শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, চিন্তা-চেতনার সংস্পর্শে এসে ঋদ্ধ হলেও নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জাতিগত স্বাতন্ত্র্যকে মনের মধ্যে ধারণ ও লালন করেছে। তাই বাঙালি জাতীয়তাবোধের এই উন্মেষে ভিনদেশি শাসক শ্রেণির ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। ইংরেজরা এদেশীয় ভাষা-সংস্কৃতির জন্য কখনোই হুমকি ছিল না, যেমনটা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বরং বাংলা ভাষার শিকড় সন্ধানের কাজটি মূলত তাদের হাত দিয়েই শুরু হয়।

প্রশাসনিক প্রয়োজনে স্থাপিত হলেও বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অবদান বিদ্বান ব্যক্তিমাত্রই জানেন। যতদূর জানি, কোনো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনই কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু হয়নি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ছিল না। অথচ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থায় দেশ ও জাতির চরম সংকটে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল সময়ের দাবি। অর্থাৎ সময়ের প্রয়োজনেই দেশের তৎকালীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর দলীয় ছাত্ররাজনীতির বহুধাবিভক্ত ধারার বীভৎস রূপ আমাদের বারবার হতবাক করেছে।

তাই সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্ট এই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করাও আজ সময়ের দাবি। এই মতের বিরোধিতা করে প্রায়ই একটি যুক্তি দেখানো হয়- মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। অথচ ক্যানসারের চিকিৎসায় শরীরের ক্ষতিকারক কোষগুলো ধ্বংস করতে গিয়ে উপকার কোষগুলোও ধ্বংস করা হয়। অনেকে আবার জাতীয় নেতৃত্বে শূন্যতার আশঙ্কার কথা বলেন। নেতৃত্বের সুষ্ঠু বিকাশে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নয়, প্রয়োজন দেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত নৈতিক বোধসম্পন্ন মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত সক্রিয় ছাত্রসংসদ।

লক্ষণীয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন বা শিক্ষক সমিতির নির্বাচন কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের নামে হয় না। এ থেকে বোঝা যায়, দেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এসব সংগঠনের আইনগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এর ৯০(খ) অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তাতে বলা আছে- নিবন্ধনে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা ছাত্রের সমন্বয়ে কোনো সহযোগী বা অঙ্গসংগঠন না থাকার সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে। ১৯৮৮ সালে মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক ছাত্র সংগঠনগুলোকে অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি এবং নির্বাচন কেন্দ্র করে শিক্ষকদের দলীয় মনোভাব শিক্ষার পরিবেশ ভয়াবহ করে তুলেছে। রাজনৈতিক কারণে উদ্ভূত এ সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধানের সুপারিশ করেছিল এ কমিশন। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা কোনো রাজনৈতিক দলই এ শক্তিকে হাতছাড়া করতে চায়নি। বিশ্ব জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র‍্যাংকিং হয়, তাতে রাজনীতিচর্চায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো দক্ষতা বিবেচনায় আসে না। সেখানে জ্ঞান উৎপাদন ও বিতরণে কাঠামোগত ব্যবস্থাপনা, পাঠক্রম, প্রকাশনা ও সার্বিক পরিবেশ বিচার্য বিষয়। ঐচ্ছিক কাজ যখন মূল কাজের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন ঐচ্ছিক কাজকেই স্থগিত রাখতে হয় মূল কাজকে নিরবচ্ছিন্ন রাখার স্বার্থে।

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাত্রদের দাবির মুখে কিছু উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন জরিপে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষেই মত দিয়েছেন অধিকাংশ মানুষ। তার পরও শিক্ষাঙ্গনগুলোয় রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনকে কারা, কীসের স্বার্থে সক্রিয় রাখতে চায়, সহজেই অনুমেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের আবাসিক ছাত্র থাকাকালে অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের একটি বড় কারণ তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে অছাত্র বা বহিরাগতদের অবৈধ আবাসন, কোর্স সমাপনীতেও বছরের পর বছর হলে অবস্থান, হল প্রশাসনের অসহায়ত্ব এসবের মূল কারণ বিদ্যমান ছাত্ররাজনীতি। তারপর বাজেট ও ব্যবস্থাপনা। শিক্ষাকে যদি সত্যিই আমরা জাতির মেরুদণ্ড মনে করে থাকি, তাহলে এ ক্ষত দূর করা জরুরি।

লেখক : প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close