শতদল বড়ুয়া

  ১৩ নভেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

প্রকৃতির তিন কন্যা

আমাদের এই মমতাময়ী বাংলাদেশ নানারূপে শোভিত। ছয় ঋতুর বাহারিরূপে রূপায়িত হয় প্রাকৃতিক পরিবেশ। অপরূপ বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যময় করে তোলে ছয় ঋতু। ঋতুর জ্যেষ্ঠ সন্তান গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে মানবকুল দিশাহারা হয়। খাল, বিল, পুকুর, ডোবা শুকিয়ে যায়। সবুজ ঘাসের ওপর বালির আস্তরণ। কাল বৈশাখীর তাণ্ডব নৃত্যে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। আবার এ ঋতু অকৃপণ হাতে আমাদের উপহার দেয় নানা রকমের ফল।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আমি ছয় ঋতুর বিশদ বর্ণনায় যাচ্ছি না। ঋতুর রানিকে নিয়ে শুরু করছি তিন ঋতুর বর্ণনা। শরৎ, হেমন্ত ও শীত- এই ঋতুগুলোর রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। আমরা ঋতুর বিষয়ে তেমন ভাবি না বলে কোন ঋতু কোন সময় সক্রিয় হচ্ছে টের পাচ্ছি না।

ঋতুরাজের তৃতীয় সন্তান ‘শরৎ’। বর্ষার শেষে এ ঋতু নবসাজে সজ্জিত হয়ে আসে বলে হয়তো এই ঋতুকে ঋতুর রানি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এ ঋতুবৈচিত্র্যে এসেছে অকল্পনীয় পরিবর্তন। বর্ষা যখন দেরিতে বিদায় গ্রহণ করে, তখন শরতের আয়ু কমে যায়। এর জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী আমরা। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে এ ঋতু বিদায় গ্রহণ করলেও এর রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য।

খাল, বিল-ঝিলে যখন কাশের ফুল আত্মপ্রকাশ করে, তখন অপরূপ শিহরন জাগে। কবি শরতের কবিতা লিখতে গিয়ে বলেছেন-

‘শরতের শস্যখেত ফল ভারে নত,

আকাশের মেঘগুলো ধায় অবিরত।

কাননে কুসুম ফোটে, ফোটে শেফালী,

অরুণ আলোকে ধরা হাসে সোনালী।’

রাতের বেলা শরৎ শশীর উজ্জ্বল কিরণে পথঘাট প্লাবিত হয়ে অপরূপ মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মৃদুমন্দ বাতাস, ফুলের মিষ্টি সুবাস, নীল আকাশের বুকে জোছনার ঝলমল শোভা মনকে উদাস করে তোলে। এ কারণে কবি লিখেছেন-

‘এবার অবগুণ্ঠন খোল,

গহন মেঘ-মায়ার বিজন বস ছড়ায়,

তোমার আলসে অবগাহন হলো সারা।

শিউলি সুরভি রাতে,

বিকশিত জ্যোৎস্নাতে,

মৃদু মর্মর গানে।

শরতের বাহারি বৈশিষ্ট্য আর কোনো ঋতুর সঙ্গে মিল নেই। ক্ষীণ আয়ুতেও এ ঋতু প্রকৃতিকে করে সুশোভিত। শীতের আগমনী বার্তা দিয়ে এ ঋতু ধীর পায়ে প্রস্থান করে। শরৎকে বিদায় জানিয়ে আসে হেমন্ত। মাঠে মাঠে তখন ফসল কাটার গান। ঘরে ঘরে হয় নবান্ন উৎসব। ভোরবেলায় দূর্বাঘাসের ওপর শিশির বিন্দুগুলো মুক্তার মতো উজ্জ্বল আলো ছড়ায়। পাকা ধানে কৃষকের গোলা পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন কৃষাণ-কৃষাণীর মনে অপার আনন্দ জাগে। প্রকৃতির খেয়ালের কারণে কৃষকরা নানা চিন্তায়ও থাকে খেতের পাকা ধান নিয়ে। স্বপ্নের জাল বুনলেও মহাজনের কথা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু যেন মিইয়ে যায় কৃষকের। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলালেও সুখের ভাগীদার হয়ে যায় মহাজন। এ সময় কৃষাণ-কৃষাণীর মনে নতুন করে বাঁচার আশা জেগে উঠলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফল বাস্তবায়নের মুখ তারা দেখে না।

হেমন্ত ঋতু কৃষকের আশার প্রদীপ হয়েও আলো দেয় অন্যদের। তবু কৃষক হেমন্তকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসে। শীতল বাতাসে শীতের আগমন জানতে পেরে কৃষক প্রস্তুতি নেয় নানা আয়োজনের। কার্তিকে শুরু হয়ে অগ্রহায়ণে এই ঋতুর যবনিকা ঘটে। এ জন্য কবি ঋতুর মধ্যে শরৎ ও হেমন্তকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। বস্তুত এই দুই ঋতুতেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক শোভা এবং মানুষের মনে আনন্দ যেন হাত ধরাধরি করে নেমে আসে। এ সময় গ্রীষ্মের দাবদাহ থাকে না। বর্ষার এক ঘেয়ে ধারাবর্ষণ বা শীতের নিষ্ঠুরতাও থাকে একেবারে অনুপস্থিত। এই দুই ঋতু যেন বয়ে আনে শান্তি ও আনন্দের বারতা।

ঋতুরাজের পঞ্চম সন্তান হলো ‘শীত’। আমাদের এই দেশে হেমন্তের বিদায়ের পরে শীত আসে। এ জন্য এই ঋতুকে ‘শীতল’ ঋতুও বলা হয়ে থাকে। শীত কিন্তু আমাদের দ্বারপ্রান্তে এসে জানান দিচ্ছে এভাবে- তোমরা তৈরি থেকো শীত নিবারণের প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে। আসলে কথা ঠিক, শীতের আগমনে সোনালি মাঠ রিক্ততায় ভরে ওঠে। এ সময় উত্তর দিক থেকে হিমশীতল বাতাস ঘরের জানালা-দরজায় লুটোপুটি খায়। আমরা সবাই জানি আমাদের দেশে শীতকালে দিন ‘ছোট’, রাত ‘বড়’। বাংলাদেশ কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর অবস্থিত। সূর্য তখন দক্ষিণায়নে মকরক্রান্তি রেখার ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। যার কারণে দিনের পরিমাণ এসে দাঁড়ায় নাকি ১০ ঘণ্টায়।

শীত কুয়াশার ঋতু। গাছের সবুজ পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং পাতা ঝরে যায়। এ সময় চলাফেরায় বেশ আনন্দ উপভোগ করা যায়। শীতকে কর্মী ঋতু হিসেবে বলা হয়ে থাকে। কারণ এ সময় কাজে তেমন ক্লান্তি আসে না। কৃষকরা শীতের সকালবেলায় মিষ্টি রোদে পরিশ্রম করতে আনন্দ পায়।

শীতকালে গ্রাম এবং শহরের দৃশ্যপট দুই মেরুতে অবস্থান করে। শীতের প্রকোপ শহরে কম আলিশান ইমারত এবং ঘন বসতির কারণে। শীত এ জন্য শহরে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না। গ্রামের মানুষ শীতের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে যায়। প্রকৃতির অকুণ্ঠদানে গ্রামবাসী ধন্য হয় বেশি। মাঠে প্রচুর শাকসবজি উৎপন্ন হয়। বাড়িতে বাড়িতে নতুন ফসলের সমাহার, রং-বেরঙের ফুলের শোভা ও গোলাপ গাদায় নয়নাভিরাম রূপে প্রকৃতির মালঞ্চ ভরে ওঠে।

আরামদায়ক শীত কিন্তু গরিবদের জন্য অভিশাপ। গরিবরা টাকার অভাবে শীতের গরম কাপড় কিনতে পারে না। ছেঁড়া কাপড় গায়ে আগুনের পাশে বসে উষ্ণতা নেওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালায়। ধনী লোকদের কাছে শীত বিলাসিতা মাত্র। তারা গরম কাপড় পরে দালানের লনে বসে সকালের মিঠেকড়া রোদের পরশ গ্রহণ করে। শীতকাল হিমশীতল ও শুষ্ক ঋতু হলেও এ দেশে শীতকাল বেশ উপভোগ্য। শীতকালের বিষয়ে অনেক কিছু লেখা যায়। লেখার সব অর্থ দাঁড়াবে একটাই, শীতকাল ধনীলোকের পরম বন্ধু এবং গরিবের ঘোর শত্রু। শীতের প্রতিটি রাত গরিবের জন্য অভিশাপ। শীতে গরিবদের পাশে বিত্তবানদের দাঁড়ানো একান্ত অপরিহার্য বিষয়। শীতবস্ত্র বিতরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা গেলে সমাজের অবহেলিত দরিদ্র লোকরা শীতের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পেতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close