এম এ মাসুদ
মুক্তমত
গেম, কার্টুন ও রিলে ফিকে শিশুদের শৈশব
দুই যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো ছিল একান্নবর্তী। এমন পরিবারের কল্যাণে সন্ধ্যা হলে বাইরের চুলোয় রান্না করতেন মায়েরা। চুলো আর কেরোসিনের বাতির আলোয় নাতি- নাতনিদের নিয়ে দাদিরা বসতেন পাটি বিছিয়ে। শোনাতেন জিন, পরী, দেও, দৈত্যসহ ডালিম কুমার ও কঙ্কাবতীর সেই রূপকথার গল্প। আর শিশুরা মনোযোগ দিয়ে শুনত দাদির বলা সেই গল্পগুলো। গল্পের মাঝে একটুখানি বিরতি দিলেই শিশুরা বলত, তারপর, তারপর? কাল্পনিক হলেও সেসব গল্প জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিত ওদের। মনের আল্পনায় আঁকত ওরা জিন, পরী, দেও, দৈত্যের ছবি। ফলে বাড়ত তাদের কল্পনাশক্তি। শিশুর মানসিক বিকাশে যার অবদান ছিল অনন্য।
চড়ুইভাতি বা বনভোজনের জন্য বন, উদ্যান কিংবা নদীর কিনার- এমন জায়গা উপযুক্ত হলেও শিশুদের কাছে আমন ধানের ফাঁকা মাঠই ছিল প্রিয়। বাড়ির পাশে জমি ফাঁকা হলে নুন, তেল, মসলা, আলু এবং ডিম ও চালের জন্য জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরত শিশুরা। আর এসব দিয়ে ফাঁকা মাঠে আয়োজন করত চড়ুইভাতির। তাদের কেউ বা রাঁধত ভাত, আবার কেউবা সেদ্ধ করত ডিম ও আলু। আবার কেউবা এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে আনত খড়ি ও খড়। বাকিরা বসে থাকত চুলোর চারপাশ ঘিরে। পুবালি হাওয়ায় নিবু নিবু করা চুলোর ধোঁয়ায় চোখ কচলাতে থাকত ওরা। তবু শিশুদের চোখে-মুখে ছিল যেন আনন্দের ঝিলিক। ডিম, আলুর ডালে বনভোজন তাতেই খুশি হতো ওরা। বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় ও পুকুর পাড়ে রাতের আঁধারে জোনাকি ধরতে মেতে উঠত শিশুরা। খেলত কানামাছি, লুকোচুরি, হাডুডু, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, ঘুড়ি ওড়ানো, পুতুলের বিয়ে, মোরগ যুদ্ধের মতো কত রকম খেলা। লটকন, ডুমুর, ডেউয়া ও পানিফলের মতো বুনোফল পাড়তে যেত বনবাদারে। রঙে রঙিন মাকাল ফল নিয়ে ঘরে ফিরলে জুটত মায়ের বকুনি। কিন্তু মায়ের বকুনিও থামাতে পারত না ওদের দুরন্তপনাকে।
কিন্তু আজ সময় বদলেছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও প্রবেশ করেছি ইন্টারনেটের যুগে। পৃথিবী যেন আজ হাতের মুঠোয়। সরলমনা বাবা-মার কল্যাণে শিশু, কিশোর, কিশোরীদের হাতেও এখন স্মার্টফোন। আর দানবরূপী এই থামিয়ে দিয়েছে শিশুদের সেই দুরন্তপনাকে। খেলাধুলা ও সকাল-সন্ধ্যা পড়ার বদলে স্থান পেয়েছে কৃত্রিম কার্টুন, ভিডিও গেম, সেলফি ও রিল তৈরির কালচার। অথচ সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে পরিবারের পরই খেলার সাথিদের স্থান। কারণ শিশুর মানসিক বিকাশ, জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন এবং সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে খেলার সাথিদের সঙ্গে মেশার ফলে।
শিশুর সামাজিকীকরণের এমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের অনুপস্থিতে সম্পর্কে ভাটা পড়েছে শিশুদের। বন্ধু-বান্ধব না থাকা এবং ছোট পরিবারের ফলে মা, বাবা কর্মে ব্যস্ত থাকায় ওদের সম্পর্ক এখন স্যাটেলাইট টিভির কার্টুন চ্যানেল ও স্মার্ট ফোনের কার্টুন ও ভিডিও গেমের সঙ্গে। কার্টুন প্রিয় এই শিশুরা মনোযোগ দিয়ে দেখছে কার্টুন ও খেলছে গেম। শিশুদের নিয়ে বাবা, মা রিল বানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিশোররা একত্র হয়ে খেলছেন পাবজি ও ফ্রি ফায়ার নামক গেমগুলো। বই নয় এগুলোই এখন সঙ্গী হয়ে উঠছে ওদের। ফলে মেজাজ হয়ে যাচ্ছে খিটখিটে। ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা চোখে না পড়ায় ডাক্তারের কাছে ভিড় জমছে এখন শিশুদের। চোখে উঠেছে মাইনাস(-) চশমা। সম্প্রতি রংপুরে চার বন্ধুকে নিয়ে ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোর গুরুতর আহত হয়। এ ছাড়া রেললাইনে বসে গেম খেলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্য এবং গেম খেলতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যুর মতো খবরও আসছে পত্রিকার পাতায়। তবুও হুঁশ যেন ফিরছে না কারো।
তাই শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠাতে কার্টুন, গেম ও রিল ও সেলফি আসক্তি কাটাতে দায়িত্ব নেওয়া আবশ্যক বাবা, মাসহ পরিবারের অন্যদের। খেলতে দেওয়া উচিত বাড়ির অন্য শিশুদের সঙ্গে। তাহলে ফিরে পাবে ওরা শৈশবের আনন্দ। সকাল-সন্ধ্যা বসবে পড়ার টেবিলে। ঘটবে শিশুর সামাজিকীকরণ। হয়ে উঠবে তারা আদর্শ মানুষ।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
"