আলা উদ্দিন

  ১২ নভেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

গুজবের ছায়ায় বিভ্রান্তির বিস্তার ও সম্ভাব্য প্রতিকার

কবি শামসুর রাহমান প-শ্রম কবিতায় লিখেছেন- ‘এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে, চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।’ এর অর্থ ও তাৎপর্য আমাদের জানা। এখন মুখের কথাও ব্যয় করতে হয় না। সামাজিক মাধ্যমে অডিও, ভিডিও, টেক্সট প্রকাশ করতে পারলেই হয়ে যায়। যত আকস্মিক তত চমক। যত চমক তত ভাইরাল! গুজব এমন এক ভিত্তিহীন বা অসমর্থিত তথ্য, যা সত্য-মিথ্যা যাচাই ছাড়াই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এটি সাধারণত মানুষের মনোযোগ পেতে বা ভীতি বা ভ্রান্তি সৃষ্টি করতে ব্যবহৃত হয়।

নৃবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুজব সমাজে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে; সামাজিক অস্থিরতা ও বিভাজনের উৎস হিসেবে কাজ করে। ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের প্রতীকীবাদ তত্ত্বানুসারে, গুজব অনিশ্চয়তার সময় সামাজিক অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে এবং ভুল তথ্য ছড়িয়ে জনমনে ভয় ও সন্দেহ ছড়িয়ে দেয়। ভিক্টর টার্নারের সংকট ও সামাজিক নাটকতত্ত্ব অনুসারে, গুজব সংকটের সময়ে সামাজিক কাঠামো ভেঙে দিতে পারে। যার ফলে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের প্রক্রিয়ায় গুজব সমাজে বিভ্রান্তি, সহিংসতা ও সামাজিক অসংহতির দিকে নিয়ে যায়, যা স্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশের গুজবের বিস্তার নতুন নয়। করোনাভাইরাস নিয়ে গুজবের আধিক্য না থাকলে আমরা আরো ভালোভাবে ভাইরাসটি মোকাবিলা করতে পারতাম। যা হোক, করোনাকালের চেয়েও এখন বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে গুজব। বলা চলে, গুজব এখন গজবের রূপ ধারণ করেছে। সামাজিক মাধ্যম ভরে গেছে গুজবে। ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে কেউই বাদ যাচ্ছেন না। তৃণমূলপর্যায়ের নেতা থেকে রাষ্ট্রপতি, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ পর্যন্ত হয়ে উঠছে গুজবের সাবজেক্ট। সামাজিকমাধ্যম এবং অনলাইন প্ল্যাটফরমের দ্রুত বিস্তার গুজব ছড়ানোর উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

গুজবের প্রাদুর্ভাবের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, সঠিক তথ্যের অভাব। যখন মানুষ সঠিক তথ্য পায় না, তারা ভুল তথ্যের দিকে আকৃষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছতার অভাব। যখন সরকার বা কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপন করে, তখন মানুষ সন্দেহ ও বিভ্রান্তিতে পড়ে। মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া বিভিন্ন প্রশ্ন গুজবের জন্ম দেয়। তৃতীয়ত, জবাবদিহির অভাব। জনগণের কাছে যারা তথ্য প্রদান করে, তাদের প্রতি আস্থা বাড়ানোর জন্য জবাবদিহি গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থত, প্রতিপক্ষের ক্ষতি। অনেক সময় কেবল অন্যকে সামাজিক, পেশাগত বা রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার প্রতিহিংসায় গুজব ছড়ানো হয়।

গুজবের প্রাদুর্ভাবের আরেকটি বড় কারণ হলো আবেগ ও ভীতি। যখন কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতি মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করে, তখন তারা না জেনে বা যাচাই না করেই তথ্য ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী হয়। সচেতনতার অভাব থেকেও অনেক সময় মানুষ জানেই না- তারা গুজব ছড়াচ্ছে। গুজবের প্রভাব জাতীয় নিরাপত্তা থেকে ব্যক্তিগত জীবনেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। গুজবের মাধ্যমে এক শ্রেণির বিরুদ্ধে অন্য শ্রেণির ঘৃণা ও বিভক্তি তৈরি করা হয়। এটি জাতীয় ঐক্য ক্ষুণ্ণ করে এবং সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে আসে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে এর প্রকট রূপ দেখা গেছে।

গুজব মোকাবিলায় সরকারের উচিত সঠিক তথ্য সরবরাহ এবং সে তথ্যের ভিত্তিতে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। সঠিক তথ্যের পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। যখন জনগণ বিশ্বাস করে, সরকার তাদের সঠিক তথ্য দিচ্ছে, তখন তারা গুজবে কম মনোযোগ দেবে। এ ছাড়া গুজব ছড়ানোর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তা গুজবের গতি ধীর করতে সহায়ক হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার, সংবাদমাধ্যমসহ অন্য অংশীদারদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে, যাতে গুজবের প্রাদুর্ভাব কমানো যায় এবং সমাজে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

জনসাধারণও গুজব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে, উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকলেই গুজবের প্রসার বহুলাংশে কমে আসবে। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষার প্রসার জরুরি, যাতে মানুষ গুজবের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারে। গুজব প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারিভাবে ফ্যাক্ট-চেকিং কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। তবে এটা সার্বিক সমাধান নয়। কারণ সমাজের অল্পকিছুসংখ্যক মানুষ ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের আশ্রয় নেয়। আবার অনেকে মনে করে, ‘যা কিছু রটে, তা কিছু-না-কিছু বটে’। সুতরাং গুজবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমাজের প্রচেষ্টা জরুরি। রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, সংবাদমাধ্যম, জনসাধারণকে এ জন্য একযোগে কাজ করতে হবে।

গুজব প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কমিউনিটি এবং অনলাইন প্ল্যাটফরমে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। সংবাদমাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রচার করে গুজবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এভাবে গুজববিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। এভাবেই একটি তথ্যসমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

আমরা জানি, সত্য ও মিথ্যার যুদ্ধ চিরন্তন এবং সত্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মিথ্যা বা গুজবের বিপরীতে মিথ্যা নয়, বরং সত্যই কার্যকর অস্ত্র। গুজব ঠেকাতে সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যের পক্ষে আওয়াজ তোলা অপরিহার্য।

লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close