তানভীর সালেহীন ইমন

  ১১ নভেম্বর, ২০২৪

মুক্তমত

জীবন জ্যোতির্ময়

‘যুদ্ধ কর দৃঢ় পণে

ভয়ে ভীত হয়ো না মানব’

জীবন প্রবহমান। জীবনকে আচ্ছন্ন করে কভু রাত্রির ঘন আঁধার কখনো উজ্জ্বল আলোকিত সূর্যালোক। স্বপ্ন সম্ভাবনা আশা-নিরাশা, প্রত্যাশা-হতাশার হ-য-ব-র-ল নিয়েই জীবন।

জর্জ বার্নার্ড শ তার ‘হার্টব্রেক হাউস’ নাটকে লেখেন- ‘এই নির্বোধ বাড়ি, এই অদ্ভুত সুখী বাড়ি, এই যন্ত্রণাবিদ্ধ বাড়ি, এই ভিত্তিহীন বাড়ি। আমার উচিত এটাকে হৃদয় ভাঙা বাড়ি বলা।’ ক্ষণস্থায়ী নশ্বর ধরণীতে আমরা আমাদের মূল্যবান বর্তমানকে বিনষ্ট করি অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা, অশান্তি, অতৃপ্তি অন্বেষণ, আসক্তি, নিরাশার দোলাচলে। প্রতিমুহূর্তে নিজের আত্মবিশ্বাস আর অন্তর্নিহিত শক্তি অপচয় হয় অজানা ভবিষ্যতের অনাকাঙ্ক্ষিত দুশ্চিন্তায়। গবেষণা বলছে, বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে প্রতি ৩৫ মিনিটে গড়ে একজন আত্মহত্যা করেন।

আমরা আমাদের জীবনে ৮০ শতাংশ সঠিক পথে থাকলেও ২০ শতাংশ বেঠিকতাকে উপেক্ষা করতে পারি না বলে মানসিক প্রশান্তির পরিবর্তে অশান্তি আবাস করে আমাদের মনে ও স্নায়ুতে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য। প্রাপ্তির সম্ভারে সুদৃষ্টি না দিয়ে অপ্রাপ্তির তালিকা নিয়ে বসি আর ভাবি, যা বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে। মনুষ্য চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আত্ম-উপলব্ধি নয় বরং অন্যের ওপর দোষারোপ।

সেন্ট হেলেনাতে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আমার পতনের জন্য আমার নিজেকে ছাড়া কাউকে দোষারোপ করা যাবে না। আমি আমার নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়েছিলাম। আমি আমার নিজের বিপর্যয়কর ভাগ্যের কারণ।’ নিজের ভাগ্য নিজেকে গড়ে নিতে হয়।

জীবন আমাদের প্রত্যাখ্যান করবে পদে পদে কিন্তু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে এগিয়ে যাওয়ার। সাহসের সঙ্গে সংগ্রাম করে সম্মুখযাত্রা নিশ্চিত করতে হবে।

কবি পোপের বিখ্যাত উদ্ধৃতি হলো- ‘শৃঙ্খলা স্বর্গের প্রথম আইন’। জীবনে সঠিক পরিকল্পনা আর সুশৃঙ্খল থাকলে সফলতা আসবে তা সে যত বিলম্বেই হোক, সে জন্য একাগ্রতা নিবিষ্টতা আর ধৈর্যশক্তি আবশ্যক।

আমাদের জীবনে আমরা যা নিয়ে উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত ও শঙ্কিত থাকি, দেখা যায় এর ৯০ শতাংশই আমাদের জীবনে ঘটেনি বা আসেনি কিন্তু দুশ্চিন্তা গ্রাস করে ফেলে আমাদের সোনালি অতীত আর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে। জীবনে অনিবার্যতাকে আলিঙ্গন করতে হবে, অভিযোজিত হতে হবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে। নিজের লক্ষ্যপথ থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না শত ঝড়-ঝঞ্ঝাতেও।

লাখো লাখো আবালবৃদ্ধবনিতা হতাশার অন্ধকারে নিজেদের আচ্ছন্ন করে রাখেন শুধু সঠিক অনুপ্রেরণা আর পথনির্দেশনার অভাবে। প্রাত্যহিক প্রাণশক্তিতে আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ করে রাখতে হবে।

প্রার্থনা আর প্রচেষ্টায় প্রতিশ্রুতিশীল থাকতে হবে। জীবনে আমাদের চাওয়াকে উপলব্ধি আর পাওয়াকে উপভোগ করতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে জীবন গড়তে হবে। পৃথিবীতে নিখুঁত ও পরিপূর্ণ বলে কিছু নেই। অসুবিধায় নয় আশীর্বাদে জীবনকে অবলোকন করতে হবে।

সাত শ বছর আগে সেইন্ট ফ্র্যান্সিস বলেছেন, ‘যেখানে ঘৃণা আছে আমাকে প্রেম বপন করতে দিন, যেখানে আঘাত আছে মার্জনা, যেখানে সন্দেহ আছে বিশ্বাস, যেখানে হতাশা আছে আশা, যেখানে অন্ধকার আছে আলো, যেখানে দুঃখ আছে আনন্দ।’ জীবনের অন্তর্নিহিত মূল্যবান সম্পদকে ব্যবহার করা শিখতে হবে। বার্নার্ড শ’র বিখ্যাত দর্শন ছিল ‘আপনি সুখী কি না তা নিয়ে ভাববার অবকাশ পাওয়াই হলো দুঃখী হওয়ার গোপন কারণ’।

বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের ব্যাপকতা বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, বাংলাদেশেও গড়ে শতকরা ১৮ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় জর্জরিত। কমবেশি অধিকাংশ মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে। আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। শিশু-কিশোররা রয়েছে চরম মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এই অন্ধকারের বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে আসতে হবে আমাদের।

কবি বেলাল চৌধুরীর কণ্ঠে বলতে হয়-

‘খড় রৌদ্র আর হাওয়ায় তোড়ে শুষে নেয়

আমার সমস্ত প্রতিরোধ

ভেতরে ভেতরে টের পাই ডানার কম্পন

জীবনের অবারিত সম্ভাবনা’

জীবন যেন ভগ্ন হৃদয়ের সমাধি না হয়। জীবন একটাই। স্বপ্ন সম্ভাবনা সাফল্যের সংগ্রামে সংকল্পবদ্ধ থাকাই হোক সবার প্রত্যয়।

যত বাধা-বিঘ্নতা আসুক পথে, হৃদয়ে উচ্চারিত হোক ‘পরাজয়ে ডরে না বীর’

‘নাহি নাহি ভয়

হবে হবে জয়।’

হোক জীবন জ্যোতির্ময়!

লেখক : সাবেক জাতীয় বিতার্কিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close