শেখ রিফাদ মাহমুদ
দৃষ্টিপাত
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর নির্বাচন পদ্ধতি উপযুক্ত নয়
বর্তমানে হঠাৎই প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন (পিআর) তথা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে ছোট দলগুলো সভা-সমাবেশ এবং টকশোতে পিআর নির্বাচন ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য দাবি তুলছেন। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নির্বাচনব্যবস্থা হলো একটি পদ্ধতি, যেখানে কোনো দেশের পার্লামেন্ট বা বিধানসভায় আসন বণ্টন হয় দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে। এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যে প্রায় প্রতিটি দলের প্রতিনিধিত্ব হয় এবং জনগণের মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কিছু সমালোচনা রয়েছে এবং সামগ্রিক মূল্যায়নে এটি আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত নয়।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টন করা হয়, যা সাধারণত দ্বিকক্ষীয় সংসদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। ধরুন, একটি দেশে ১০০টি আসন রয়েছে এবং কোনো একটি দল ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছে, তাহলে সেই দল ৩০টি আসন পাবে। এভাবে ছোট দলগুলোও নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন পেতে পারে। ফলে এটি একাধিক দলের জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখে। এই ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্ব অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় হয়, যা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্ভাবনী চিন্তা আনতে পারে।
তবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কার্যকারিতা। এ ব্যবস্থা কার্যকর হলে ছোট দলগুলোও সংসদে আসন পাবে এবং এটি প্রায়ই জোট সরকার গঠনে বাধ্য করবে।
মূল বিষয়টি হচ্ছে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের প্রতি জনগণের প্রত্যক্ষ চাপ বা জবাবদিহি কমে যায়। সাধারণত সংসদ সদস্যদের স্থানীয় অঞ্চলের ভোটারদের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকে। তারা জনগণের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সরাসরি তদারকি করে থাকেন। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলে জনগণের সঙ্গে সেই সম্পর্কটি দুর্বল হতে পারে। এর ফলে জনপ্রতিনিধিরা হয়তো স্থানীয় জনগণের প্রয়োজন ও মতামতের ওপর ভিত্তি করে কাজ করবেন না, বরং রাজনৈতিক দলের স্বার্থে কাজ করতে বেশি আগ্রহী হবেন। সরাসরি নির্বাচনে প্রতিটি সংসদ সদস্য নির্দিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সেই অঞ্চলের জনগণের প্রতি তাদের প্রত্যক্ষ দায়বদ্ধতা থাকে। তবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় এমন নির্দিষ্ট সংযোগ থাকে না, কারণ জনপ্রতিনিধিরা মূলত দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। এর ফলে স্থানীয় জনগণের প্রয়োজনীয় কাজ ও চাহিদাগুলো পূরণে বিলম্ব বা অবহেলা দেখা যেতে পারে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় একাধিক ছোট দল ক্ষমতায় থাকায় জনগণের আস্থা কমে যেতে পারে। কারণ ভোটাররা মনে করতে পারেন যে তাদের ভোট সরাসরি তাদের পছন্দের প্রার্থীর প্রতি যায়নি বরং একটি দলের হাতে চলে গেছে, যাদের প্রার্থীরা সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। এটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার একটি বড় নেতিবাচক দিক হলো বিচ্ছিন্নতাবাদ ও বিভাজনের সম্ভাবনা। বিভিন্ন অঞ্চল বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে দলগুলো প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা কোনো দেশ বা সমাজের মধ্যে জাতিগত, ধর্মীয়, আঞ্চলিক, বা সম্প্রদায়গত বিভাজন বাড়িয়ে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এ ব্যবস্থায় বিশেষ সম্প্রদায়ভিত্তিক দলগুলো সহজেই সংসদে প্রতিনিধিত্ব পেতে পারে, যা বিভাজনমূলক রাজনীতির জন্ম দেয়। ফলে সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি হয় এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
এই ব্যবস্থায় ছোট দলগুলো অনেক সময় অতিরিক্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, কারণ তারা জোট সরকারের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এসব দল তখন নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করতে পারে এবং বড় দলগুলো বাধ্য হয় তাদের শর্ত মানতে। এটি নীতিনির্ধারণী কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং রাষ্ট্রের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক সময় জোট সরকার গঠন করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এমন কিছু শর্ত মেনে নেয়, যা পরে প্রশাসনিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। ছোট দলগুলো তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে জোর দিতে পারে, যা দেশের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে। এতে সরকার পরিচালনায় বিভিন্ন দলের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে বাধা হতে পারে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে পিআর ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইতালিতে এই ব্যবস্থায় বারবার সংকট তৈরি হয়েছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কারণে ছোট ছোট দল সাংসদ সংখ্যায় প্রভাব বিস্তার করে। ইতালিতে ছোট দলগুলোর প্রবেশ সহজ হওয়ার কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বারবার নির্বাচনের প্রয়োজন পড়ে। ছোট দলগুলো জোট সরকারের জন্য অনেক শর্ত আরোপ করে থাকে, যা সরকারের কাজে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সময় ব্যাঘাত ঘটে। যার কারণে সরকার পরিচালনায় বিভ্রান্তি ও অনাস্থার মতো সমস্যা সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে ওঠে এবং বারবার জোট সরকার গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বারবার নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ছোট দলগুলো প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাওয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। অনেক সময় একটি সরকার পুরো মেয়াদ পূরণ করতে পারে না এবং বারবার নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজন হয়। এটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। ইতালি, গ্রিস এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে বারবার নির্বাচনের ফলে সরকার পরিচালনায় অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা সরাসরি ভোটিং প্রক্রিয়ার তুলনায় কিছুটা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ভোটের ফলাফল পর্যালোচনা ও আসন বণ্টনের জন্য জটিল হিসাবনিকাশের প্রয়োজন হয়, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরো দীর্ঘায়িত করে এবং নির্বাচনী ব্যয়ও বাড়ায়।
আমার মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতি সম্ভবত সবচেয়ে উপযুক্ত। এতে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে তাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচন করতে পারে এবং সেই প্রতিনিধি জনগণের কাছে জবাবদিহি দিতে বাধ্য। সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় জনগণের উন্নয়নমূলক কাজগুলো তদারকি করতে পারেন এবং জনগণের সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান দিতে বাধ্য থাকেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সরকারি কার্যকারিতা এবং জনগণের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সংযোগ বজায় রাখার জন্য সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য বেশি উপযোগী। যদিও, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদিও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমর্থন করে, তবে বাংলাদেশের জন্য এটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতি আমাদের জন্য অধিক কার্যকর।
লেখক : চেয়ারম্যান, এসআরআই ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন
উপদেষ্টা পর্ষদ সদস্য, গ্লোবাল স্টুডেন্ট ফোরাম (ডেনমার্ক), এডুকেশন রিলেশন অফিসার, কমনওয়েলথ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন
"