মারিয়া হক শৈলী
মুক্তমত
প্রসঙ্গ সাত কলেজ : সংস্কারই যৌক্তিক সমাধান
আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে, ২০১৪ সালের শেষের দিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের প্রথমসারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে নিজেদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা দান করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট, এই সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। এই সিদ্ধান্তেরই ধারাবাহিকতায় প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, ২০১৭ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজ (ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাংলা কলেজ এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়।
শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও কয়েক বছর যেতে না যেতেই তাদের মুখোমুখি হতে হয় নানা সংকটের। পর্যাপ্ত অ্যাকাডেমিক ভবন না থাকা, সেশনজট, ক্লাসরুম সংকট, পর্যাপ্ত হলের ব্যবস্থা না থাকা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সম্ভাব্য তারিখ অনুযায়ী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়া, শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক স্বল্পতা, লাইব্রেরির মানহীনতা, শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নে ঢাবির গুরুত্বহীনতা, পাশাপাশি সমাবর্তনে বৈষম্য- এসব নানা অসুবিধার কথা বিভিন্ন সময় অভিযোগ কিংবা আলোচনা আকারে ঢাবি কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও আসেনি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন, আসেনি কোনো সুদূরপ্রসারী সমাধান। এরই ফলে ২০১৯ সালের অসফল আন্দোলনের পর, আবারও রাস্তায় অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঢাবির অধিভুক্তি বাতিল চেয়ে তাদের এবারের দাবি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সমর্থন দিতে দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- সময়, স্থান ও পরিবেশ বিবেচনায় সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিটি কতটুকু যৌক্তিক?
আমরা জানি, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক নিয়মে বেশ পরিবর্তন আসে। জরুরি ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাধ্যমে ৫ আগস্ট পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিবেশ স্থিতিশীলতায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা এখনো চলমান। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। এসব দাবিদাওয়ার মধ্যে এমনও কিছু দাবি আছে যেগুলো মূলত সংসদীয় সরকার কর্তৃক অনুমোদন বা সমাধানের যোগ্যতা রাখে। সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিটিও ঠিক তাই। তা ছাড়া অধিভুক্ত সাতটি কলেজের অনেক কলেজেই উচ্চশিক্ষার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তর উচ্চমাধ্যমিক শাখা এখনো বিরাজমান। এ ছাড়া সাতটি কলেজের কিছু কলেজের আয়তন ও দূরত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব, বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক কর্তৃক পাঠদান ইত্যাদি বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিটি কিছুটা অবাস্তব।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের এ দাবি মেনে নেওয়ার কথা। যদিও ঢাবি শুরু থেকেই অধিভুক্তির বিপক্ষে ছিল। বিপক্ষে থাকার কারণগুলোও বেশ যৌক্তিক। যেমন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রশাসনিক অবকাঠামো, সাত কলেজের দুই লাখ শিক্ষার্থীকে যথাযথ সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ঢাবির অনেক শিক্ষক বর্তমানে সাত কলেজের পরীক্ষা কমিটির সদস্য। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সাত কলেজের ১৫ শতাংশ খাতাও দেখে থাকেন, আগে যেমন ৭০-৮০টি খাতা দেখার চাপ ছিল এখন সাতটি কলেজ যুক্ত হওয়ার পর ৩০০-৪০০ খাতা দেখতে হয়। ফলে, বিশ্ব র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকা ঢাবির মান উন্নয়নে যে দীর্ঘসময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্যয় করার কথা, সেটি চাইলেও পুরোপুরি হয়ে উঠছে না বলে মত ঢাবি শিক্ষার্থীদের। ফলে দিন দিন কমছে ঢাবির শিক্ষার মান।
যদিও শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বর্তমান সরকার তাদের অবস্থান ইতিমধ্যেই কিছুটা স্পষ্ট করেছে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (কলেজ) সভাপতি করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই একটি আলাদা প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে, যার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা শুধু সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সেবায় নিয়োজিত থাকবেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এ সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়েই তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাইছে। হ্যাঁ এ কথা ঠিক যে, দেশের বিভিন্ন অলিগলিতে দু-একটি বিল্ডিং বা ফ্ল্যাট নিয়েই বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে সাতটি কলেজের বেশ কয়েকটি কলেজেই বেশ মনোরম পরিবেশ বিদ্যমান রয়েছে ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সুবিধা, যা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
পরিশেষে, আমাদের সবারই উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে নৈতিকভাবে স্বচ্ছ হওয়া এবং দায়িত্বের সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন। শিক্ষার্থীদের উচিত নিয়মিত অধ্যয়ন এবং শিক্ষকদের উচিত ছাত্রছাত্রীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে যদি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক না থাকে, যদি শিক্ষার্থীরা বিশ্বমানের সুযোগগুলোর সঙ্গে নিজেরা পরিচিত হতে আগ্রহী না থাকে, সবই যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ভেবে বসে থাকে, তাহলে যতই একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হোক কিংবা সংস্কার করা হোক, অথবা যাই করা করা হোক না কেন, সে উন্নয়ন বা পরিবর্তন খুব বেশিদিন টেকসই হবে না। অধিভুক্ত সাত কলেজের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বর্তমান সমস্যার খুব দ্রুতই একটি যৌক্তিক সমাধান হোক এই প্রত্যাশা করি।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা
"