মাছুম বিল্লাহ
দৃষ্টিপাত
ইন্দোনেশিয়ায় ভাষা ও শিক্ষা সম্মেলনের অভিজ্ঞতা
ইন্দোনেশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন, ইন্দোনেশিয়ান ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন, ব্রিটিশ কাউন্সিলের আয়োজনে অক্টোবরের ২৩ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভা প্রদেশের রাজধানী বান্দুংয়ে অনুষ্ঠিত হলো ভাষা ও শিক্ষা সম্মেলন। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমন্ত্রণ পাই। তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ঘুরে আসি বান্দুং। ইন্দোনেশিয়া উন্নত দেশ নয়, তবে দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। দেশটিতে যা ভালো লেগেছে, তা হলো বান্দুং কিংবা জাকার্তা কোথাও কিন্তু গাড়ির হর্ন বাজানো হয় না। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই। রাস্তায় এমনি পুলিশের দেখাও নেই, যা আমাদের সিটিগুলোয় অহরহ দেখা যায়। এটি একটি পজিটিভ সাইনই বলা যায়। আর বান্দুং সিটি গাছপালা দিয়ে ভর্তি যদিও জাকার্তায় বান্দুংয়ের মতো এত গাছপালা দেখিনি।
যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো। ড. ডায়ানা স্মিথ-ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডনের অধ্যাপক। তিনি শিক্ষায় এবং ভাষা শিক্ষায় ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ কিংবা সামাজিক বিচার বিষয় নিয়ে কথা বলেন এবং উপস্থাপনা করেন। তার আলোচনার বিভিন্ন দিকের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে তুলে ধরেন। শিক্ষার্থীরা ছিলেন এই আন্দোলনের অগ্রভাগে। তারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে, ফলে কয়েকজন শিক্ষার্থী শহীদ হন। পুরো ইতিহাস তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সবার উদ্দেশে বলেন। এ ঘটনাটিকে তিনি শিক্ষায় ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ বলে অভিহিত করেন। শিক্ষার্থীরা সামাজিক বিচার করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, শিক্ষকদের এবং শিক্ষার্থীদের যেসব দায়িত্ব থাকে তার মধ্যে এই ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়, যা এক ধরনের ‘সোশ্যাল জাস্টিস’। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাজ শুধু সিলেবাস অনুসরণ করে পড়া, পড়ানো আর পরীক্ষা দেওয়া বা নেওয়া নয়। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ও নিঃস্বার্থ ভূমিকা পালন করতে হয়, যা ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ নামে পরিচিত। এখানেই শিক্ষার মূল সার্থকতা নিহিত।
ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হলেন ড. বি আর আম্বেদকর। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা জাতপাত ব্যবস্থায় সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণ। তিনি সামাজিক অধিকার, সাম্য, ন্যায়, স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি মূল্যবোধগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা জরুরি বলে মনে করেন। তিনি শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত দলিতদের জন্য প্রকৃত অর্থেই অধিকার ও ন্যায়-বিচার যাতে পান, তার সুব্যবস্থা করেছিলেন এবং অন্যদের তা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। ডা. ডায়ানা আরো বলেন, লন্ডনের বিদ্যালয়গুলোয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ২৭২টি ভাষায় শিক্ষাদান করা হয়। এটিকেও তিনি ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ বলেছেন, কারণ সব ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এই নীতির মাধ্যমে। তিনি ভিডিওতে দেখিয়েছেন লন্ডনের স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা কোন কোন ভাষায় লেখাপড়া করছেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে সিলেট থেকে লন্ডনে যাওয়া শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বাংলা না শিখে ইংরেজি শিখতে চান। কেন বাংলা না শিখে ইংরেজি তারা পড়তে চান এবং ইংরেজি ভালোভাবে শিখতে চান, তার ওপর তিনি গবেষণা পরিচালনা করে দেখেছেন, বাংলাদেশের সিলেটিরা বলেছেন, বাংলা শিখতে চাওয়া বা বাংলায় কিছু পড়তে যাওয়া মানে সময় নষ্ট করা, যা তাদের কোথাও কোনো কাজে লাগবে না। ওই অধ্যাপকের উপস্থাপনার পর প্রশ্নোত্তর-পর্বে আমি তাকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এবং বাংলাদেশের ভাষার ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশে দুমাস আগে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, সেটিকেও তিনি ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ বলবেন কি না উত্তরে অধ্যাপক বলেছেন, তিনি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ইতিহাস পুরোটা জানেন না। তবে, শিক্ষার্থীরা যা করেছেন, তা ‘সোশ্যাল জাস্টিসে’র মতো কাজ।
যেকোনো শিক্ষায়, যেকোনো জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ভাষা একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একজন শিক্ষক বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন, তাকে ভাষা ব্যবহার করতেই হচ্ছে। তার ভাষা যত উন্নত ও মাধুর্যময় হবে, তার শিক্ষাদান প্রক্রিয়াও তত উন্নত হবে। এভাবে গণিত, ব্যবসায় শিক্ষা, পরিবেশবিজ্ঞানসহ শিক্ষার সব ক্ষেত্রেই কিন্তু ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে। ফলে, তারা যতটুকু কোনো বিষয়ে বুঝেছেন, সেটিকে সেভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। আর প্রকাশ করতে না পারার অর্থ হচ্ছে, তারা যা শিখেছেন সেটি অনেকটাই কার্যকর নয়। গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীরা বহু ভাষায় জ্ঞান অর্জন করছেন, শিক্ষায় নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করছেন সেগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দিতে, অন্যান্য দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজিই সেই ভাষার স্থান দখল করে আছে। যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তাদের এই ভাষায় অবহেলা করা মানে বৈশি^ক দৌড়ে পিছিয়ে থাকা। সেটি কোনোভাবেই করা যাবে না।
বাংলাদেশের শিক্ষা, শিক্ষায় ইংরেজির অবস্থান, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখানে যেসব চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয় এবং কীভাবে বাংলাদেশের শিক্ষকরা সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন এবং ইংরেজিকে ফলপ্রসূভাবে শেখান সেসব বিষয়ের ওপর আমি একটি উপস্থাপনা করি। তারপর একটি প্যানেল ডিসকাশনেও কথা বলেছি। বাংলাদেশে শিক্ষার অবস্থা, মান ও ইংরেজির অবস্থান কি দর্শকরা জানতে চাইলে আমি বলেছি, বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ধারণা এখনো জড়িয়ে আছে। আর ইংরেজি বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে ১২ বছর পড়ানো হলেও শিক্ষার্থীরা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা এটিকে একটি বিষয়ের মতো পড়েন। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে এটিকে ব্যবহার করার জন্য পড়েন না। পরীক্ষায় পাস করা ও সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য তারা ইংরেজি পড়েন। কিন্তু চাকরিতে যেহেতু এই ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাই শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষ করার পর ইংরেজি জানা শুরু করেন, যাতে চাকরি পাওয়া যায়। আর সেটি তারা করেন বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি পরিচালিত কিংবা ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে। আমাকে আরো প্রশ্ন করা হয়েছিল, শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয় সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ইচ্ছা থাকতে হয় কিন্তু সেই ইচ্ছে সরকারি প্ল্যান-প্রোগ্রামে দেখা যায় না। এটির সমাধান কী? এই প্যানেল ডিসকাশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমি এবং কোরীয় অধ্যাপক ড. জনসন আর. বেকার ছিলেন। আমাদের দুজনকেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে অনেক দেশের সরকার শিক্ষার প্ল্যান ও পরিকল্পনা করে কিন্তু সব সময় তা দেশের মানুষ যা চায়, শিক্ষার্থীদের যেভাবে দরকার, শিক্ষকদের যা অনুকূলে যাবে যেসবের মাঝখানে বিরাট ফারাক থেকে যায়। এখানে আপনাদের সাজেশন কী এবং এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশে কী করা হয়, যা ইন্দোনেশিয়ার জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। উত্তরে আমরা বলেছি, শিক্ষার্থীরাই এক দিন সরকার হবে, অনেক দেশের সরকারই শিক্ষার অনুকূলে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে না কিংবা নেয় না। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে ভালোভাবে পড়াবেন, ফলপ্রসূভাবে পড়াবেন এবং দক্ষ শিক্ষার্থী তৈরি করবেন, তখন ওই শিক্ষার্থীরা একসময় শিক্ষকের কথা মনে করে সবকিছু বাস্তবায়ন করবেন। এটি দ্রুত কোনো বিষয় নয়, সময়সাপেক্ষ। আর শিক্ষক সংগঠনগুলোকে দৃশ্যমান ভূমিকা পালন করতে হবে, যা যেকোনো দেশের সরকারকে সেনসেটাইজ করবে এবং অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের চিন্তা করবে। তবে শিক্ষকদের পদক্ষেপগুলো এমন হতে হবে, যাতে সরকারকে পজিটিভলি শিক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা যায়। শিক্ষকদের প্রধান কাজ অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে এবং ইনোভেটিভ পন্থায় শিক্ষাদান করা, যা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্থেই কাজে লাগে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সিঙ্গাপুরের অধ্যাপক উইলি এ. রেনানডিয়া বলেছেন, শিক্ষায় সমস্যা থাকবেই, সেটি নেগেটিভ কিছু নয়। সমস্যা থাকা মানেই হচ্ছে শিক্ষকদের কাজে ব্যস্ত থাকা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় এনগেজড রাখা। সমস্যা না থাকলে নতুন নতুন চিন্তা কেউ করবে না, নির্জীব হয়ে পড়বে। শিক্ষকদের নতুন কিছু আবিষ্কার করতে গেলে সমস্যার মধ্য দিয়ে সাঁতড়ে যেতে হয়, তাদের নতুন কিছু আবিষ্কার করে বিশ্ব শিক্ষায় কাজে লাগাতে হবে আর সে জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্যাবলিকে নেগেটিভলি দেখা যাবে না, ভাবা যাবে না। কিন্তু অনেক শিক্ষক সমস্যা দেখলেই ঘাবড়ে যান, কাজ না করার বিভিন্ন অজুহাত খুঁজেন, যেটি ঠিক নয়। সমস্যা না থাকলে তারা শিক্ষার এক্সসাইটমেন্ট কোথায় পাবেন, কোথায় গবেষণা করবেন, কীসের ওপর গবেষণা করবেন? শিক্ষায় সমস্যা সব দেশেই আছে, তার রকমফের ভিন্ন কিন্তু সমস্যা আছেই। আর সমস্যা আছে বলেই শিক্ষকরা উজ্জীবিত আছেন।
লেখক : শিক্ষাবিশেষজ্ঞ ও গবেষক
প্রেসিডেন্ট : ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)
"