ড. মাহবুব হাসান
ব্যবস্থাপনা
হজ প্যাকেজ ও বাস্তবতা
সম্প্রতি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা। গত বছরের তুলনায় এবার ১ লাখ ৯ হাজার টাকা কমিয়েছে সরকার। এ সংবাদ দিনকয়েক ধরেই চাউর হচ্ছিল, বেসরকারি কথা হিসেবে। আজকে ঘোষিত হওয়ার পর মনে হলো, আর্থিকভাবে দুর্বল যারা হজব্রত পালন করতে চান, তাদের হৃদয়ে একটি ভালো অনুভূতি খেলে যাবে। তবে পরের বাক্যেই আমরা জানতে পারি, এবার প্রত্যেক হাজিকে ৪০ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে যেতে হবে খাবারের জন্য। আজিজিয়া প্যাকেজের অধীনে তারা থাকবেন দু-তিন কিমি দূরে। আজিজিয়া সড়কটি শুরু হয়েছে কাবা চত্বরের পশ্চিমদিক থেকে। তার ডান পাশের সড়কটি ইবরাহিম সড়ক। তার ডান পাশের সড়কটি কবুতর চত্বর ও পাশে হিজড়া সড়ক। এই সড়কগুলো উঠে গেছে পাহাড়ের দিকে, উঁচুতে। সেখানে কিছু নতুন বাসাবাড়ি তৈরি করেছে সৌদি সরকার। সেগুলোতেই বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি হাজিদের আবাসনের জন্য রাখা হয়েছে। যারা প্রিমিয়াম ক্লাসের হজযাত্রী, তারা আরো মূল্যবান প্যাকেজে যাবেন। তারা থাকবেন কাবা চত্বরের সঙ্গে লাগোয়াপ্রায় পাঁচতারকা হোটেল। কিছু থাকবেন চারতারকা হোটেলে। আজিজিয়া সড়কের প্রায় সব হোটেলই চারতারকার হোটেল বলে শুনেছি। তবে সেগুলোর কোনো কোনোটার রিসেপশনে গিয়ে মনে হয়নি, সেগুলোর মান চারতারকার। তবে ঢাকার তারকাবিহীন হোটেলগুলোর মতোই তাদের স্ট্যান্ডার্ড। সব হোটেলই সার্বক্ষণিক এসিচালিত। সে জন্য বাইরে ৪৩ থেকে ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকলেও বাইরে কোনো হাজি অপেক্ষা করেন না।
২.
এবার অভিজ্ঞতার কথা। গতবার আমি এক বেসরকারি কোম্পানির অধীনে হজে যাই। আট লাখ টাকার প্যাকেজে। তারা বলেছিল, স্ট্যান্ডার্ড খাবার পরিবেশন করবে। সকাল বেলার নাশতার যে ব্যবস্থা পেলাম, তাতে মনে হলো আমরা অতিথি হিসেবে এসেছি। তারা যা পারছেন, তাই আমাদের খাওয়াচ্ছেন। নিম্নমানের খাবার বলা চলে। হাজিরা যাতে প্রতিবাদ করতে না পারেন, সে জন্য সবুর করতে বলা হয়েছিল এবং একটি কাগজে তাদের সেবা ও খাবার পরিবেশনের বিরুদ্ধে কোনো ওজর- আপত্তি জানাতে পারবেন না বলে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল। একটি ডাবল সিটেড রুমে আমাদের চারজনকে থাকতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে যে নামাজ আদায় করব, সে পরিসর ছিল না। তার ওপর এক দিন চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা হিসেবে নিয়ে এলেন সাব্বির আহমেদ নামের হাব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছি আমরা। বললাম, থাকার অবস্থা দেখে কী মনে হয় আপনার? তিনি চুপ করে থেকে চলে গেলেন।
এমন বিরক্তিকর মিথ্যাচার যে তাদের বিরুদ্ধে কিছু লিখব ভেবেছিলাম, কিন্তু লেখা হয়ে ওঠেনি। আজ যখন নতুন করে হজ প্যাকেজ ঘোষিত হলো, মনে হলো, সত্য লেখা উচিত। বলা হয়েছিল, ২০০-৩০০ মিটারের মধ্যে আমাদের হোটেল হবে। বাস্তবে পেলাম ৭০০-৮০০ মিটারের বেশি ওপরে, মানে পাহাড়ের ওপরে। যারা আজিজিয়া সড়কের হোটেলগুলোয় ছিলেন, তারা জানেন, ওই সড়কটি ধীরে ধীরে পাহাড়ে, আসলে পর্বতে উঠে গেছে। কালো পাথরের পর্বত। সেই পর্বত কেটে হোটেল বানানো হয়েছে। যেহেতু হজব্রত পালনের একটি কাজে তারা গিয়েছিলেন, শত কষ্ট হলেও তা সহ্য করেছেন। হজ-ব্যবসায়ীর লোভের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেননি তারা। এবারও তারা হাজিদের নিয়ে যাবেন। হয়তো আগের আচরণই করবেন।
৩
এবার সরকার হাজিদের ব্যয়সংকোচনে সৌদি আরবের কাছে থেকে কিছুই আদায় করতে পারেনি। সৌদি সরকার পিলগ্রিমের ব্যাপারে তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসাকেই প্রধান করে রেখেছে, যা হোক, অভিজ্ঞতায় ফিরি। মদিনা মুনাওয়ারায় যে হোটেলে তোলা হলো, সেখানেও দুই বেডের একটি ফ্যামিলি রুমে আমাদের চারজনকে রাখা হয়। তত দিনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, আমাদের হজের পবিত্রতা ও আবেগের দাম ওরা তুলে নিয়ে গেছে। নাশতা ও দুপুর/রাতের খাবারের মান সামান্য ভালো বলতে হচ্ছে। অভ্যস্ততার কারণে আমরা তুলনা করতে পারছিলাম না কোনো কিছুর। তবে মদিনার খাবার পরিবেশনে যারা ছিলেন তারা ওই দেশের কিছু ফল খাওয়ালেন। তাতেই আমাদের মন ভালো হয়ে গেল। আর মদিনার মসজিদে নববির তিন পাশের হোটেলগুলো; পুবদিকে হচ্ছে জান্নাতুল বাকি। সব হোটেলের উচ্চতা দশতলা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল বা অন্য নামের পাঁচতারকা হোটেলে যারা উঠেছেন, তারা অনেক ভালোভাবে বা আরামেই হজব্রত পালন করতে পেরেছেন বলে বিশ্বাস করছি।
একটা তথ্য দিই। হজের অন্যতম করণীয় হিসেবে বলা হয় কোরবানি করার কথা। হজ এজেন্সির লোকরা তাদের মাধ্যমে কোরবানি দেওয়ার অনুরোধ করেন। আবার অনেকে ওই দেশের একটি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমেও কোরবানি করেন। তারা ৭৫০ সৌদি রিয়াল নেয় এবং হজের দিন তারা কোরবানি দিয়ে দেয়। নামধাম কিছু নেয় না তারা। এতে কোরবানি হলো কি হলো না, বোঝার উপায় নেই। তারা শুধু ফোনে মেসেজ পাঠায়- আপনার কোরবানি হয়ে গেছে। এর সত্যতা আছে কি না, সন্দেহ করি। আবার হজের সঙ্গে ওই কোরবানির সম্পর্কসূত্র তৈরি করা হয়েছে। অথচ কোরবানির মাংস আমাদের খাবার হিসেবে দেওয়া হয়নি।
সব মিলিয়ে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা আমার কাছে অনেকটাই ভালো ঠেকেনি। বিশেষ করে কোরবানির কোনো মানে নেই। হাজিদের ওপর হজ এজেন্সিগুলোর নির্মম আচরণ ভালো নয়। গ্রামের লোকরা সহজ-সরল। তারা কষ্টকেই ইবাদতের অঙ্গ হিসেবে মনে করে। আমরা সেবামূল্য দিয়ে কিনেও পাচ্ছি না। আমাদের সরকারও হাজিদের জন্য তেমন কোনো উপকার করতে পারছে না। তবে সেবা করার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
৪.
কীভাবে সরকার গরিব হাজিদের সেবা দেবে, তার একটি ফরমুলা দিতে পারি। সরকার তো এমন বহু খাতে টাকা দেয়, যার তলা খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার নন-প্রোডাকটিভ খাতেও হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ-ব্যয় হয়ে থাকে। তাতে জনগণের তেমন কোনো উপকারে আসে না। যদি ১২৭ হাজার হাজির মধ্যে গ্রাম ও শহর মিলিয়ে আর্থিকভাবে দুর্বল হাজিদের এক লাখ টাকা করে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তাহলে কি সরকারের তহবিলে খুব বেশি টান পড়বে? সরকার ইচ্ছা করলেই তা পারে। অগ্রাধিকারভিত্তিক নয় এমন কিছু প্রকল্প আছে, যার ব্যয়-বরাদ্দ কাটছাঁট করে হাজিদের জন্য ভর্তুকি দিতে পারে সরকার। তবে সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ভর্তুকি দেওয়ার সেই মনমানসিকতা থাকতে হবে। সেটা কী হবে?
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
"