মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হোক
দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আপত্তি ও উদ্বেগের মধ্যে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ পাস করায়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ব্যাপক সমালোচিত ৫৭ সহ কয়েকটি ধারা বাতিল করে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হলেও পুরোনো আইনের বাতিল হওয়া ধারাগুলো নতুন আইনে রেখে দেওয়ায় এর অপপ্রয়োগের শঙ্কা ছিল উদ্বেগের কেন্দ্রে। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বদলে ‘সাইবার সিকিউরিটি আইন’ করে সরকার। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তা সংসদে পাস হয়। ওই আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয় পুলিশকে।
গত ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবির মধ্যে সব ‘কালাকানুন’ বাতিল বা সংস্কারের দাবিও সামনে আসে। অবশেষে কালাকানুন হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া সেই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিল অন্তর্বর্তী সরকার। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। মতপ্রকাশ ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি হিসেবে সমালোচিত সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। এই আইনে মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষকসহ অনেকেই।
প্রসঙ্গত, বিতর্কিত ‘সাইবার সিকিউরিটি আইন’ বাতিল বা সংশোধনের বিষয়ে কিছুদিন ধরেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল। এর মধ্যে গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘অবশ্যই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা উচিত। সেদিকেই যাব। আলটিমেট এটা বাতিল হবে। পরবর্তী সময়ে যখন নতুন আইন হবে, এটার বেসিক অ্যাপ্রোচ থাকবে সাইবার সুরক্ষা দেওয়া, নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া বিশেষ করে।’ কয়েক দিন আগে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে আইনটি বাতিল হবে এবং এ আইনের অধীনে যত মামলা হয়েছে সব মামলাও বাতিল হবে।’ শুধু এই আইন নয়, মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে এমন সব আইন পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত বছর বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে তার বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছিল। কিন্তু এ আইন নিয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে আপত্তি ওঠে। এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। এখন আইনটি বাতিলের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিল অন্তর্বর্তী সরকার।
সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে সাইবার নিরাপত্তা আইন ব্যবহারের অভিযোগ ছিল। দীর্ঘদিনের দাবির পর এই বাতিল হলো। সমালোচনা দমনে, ভিন্নমতের বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি মতপ্রকাশে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে এই আইনের ক্রমাগত অপপ্রয়োগ হয়েছে। নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেরই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা দরকার। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে ছিল সাইবার নিরাপত্তা আইনটি। অন্তর্বর্তী সরকার এই আইন বাতিল করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করে এমন আইন তৈরি হবে না, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
"