মো. নাজমুল ইসলাম
দৃষ্টিপাত
বিপ্লব উত্তর বাংলাদেশে আমজনতার প্রত্যাশা
গত শতাব্দী হতে অদ্যাবধি পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছে উত্থান-পতনের অনেক গল্প। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আধুনিকতার অগ্রযাত্রা থেমে নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিটি জাতি তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে শিক্ষা, গবেষণা ও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখছে এবং উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করছে।
আত্মপরিচয় ও চেতনা একটি জাতির উন্নয়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। একটি সভ্যতাকে কেন্দ্র করে উৎপত্তি হয় কোর রাষ্ট্রের। আর সভ্যতার নিজ চেতনা ও দর্শনকে সামনে রেখে ব্যক্তি, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি পরিচালিত হয়। যেমন: পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়নে তাদের মূল্যবোধ, চেতনা ও বিশ্বাসসমূহ হল: ব্যক্তি স্বাধীনতা, সমতা, গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সরকারের প্রতি সন্দিহান থাকা ইত্যাদি। এ সব চেতনার উপর ভিত্তি করেই তারা বিশ্ব শাসন করছে। অন্যদিকে বিশ্বের নব্য পরাশক্তি চীনের উন্নতি হয়েছে কনফুসিয় ধারার মধ্য দিয়ে। কনফুসিয় মতবাদের মধ্যে রয়েছে: মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্বারোপ, কর্তৃপক্ষের প্রতি মান্য, পদসোপান পুরোহিততন্ত্র, ব্যক্তিগত অধিকার বা স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া, ঐক্যমত্যের উপর গুরুত্বারোপ এবং সর্বোপরি সমাজ ও ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রের আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা।
এছাড়াও জাপান, ম্যাক্সিকো, রাশিয়া, ভারত সহ অনেকগুলো রাষ্ট্র রয়েছে যারা নিজেদের চেতনা ও মূল্যবোধকে ব্যবহার করে নিজেদের একটি কোর রাষ্ট্র হিসাবে দাঁড় করিয়েছে। এ সব কোর রাষ্ট্র ব্যতীত আরো কিছু ছিন্ন রাষ্ট্র রয়েছে যাদের নিজস্ব চেতনা, সভ্যতা ও মূল্যবোধ নেই, কিন্তু অন্যের চেতনা ধার করে নিজেদের উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল করেছে।
কাতার (১৯৭১), কুয়েত (১৯৬১), আরব অমিরাত (১৯৭১), জার্মান, সিঙ্গাপুর (১৯৬৫), মালয়েশিয়া (১৯৫৭) সহ আমাদের সমসাময়িক সময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী অনেক দেশ শক্তিশালী অর্থনীতি ও প্রশাসন তৈরি করেছে। অথচ আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে স্বনির্ভর অর্থনীতি, শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো, গবেষণা মুখি শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে ব্যর্থ হয়েছি, যা একটি স্বাধীন দেশের জন্য লজ্জাজনক। তাহলে আমাদের সংকট কোথায়?
আমাদের রয়েছে প্রেরণাদায়ক চেতনা। যে চেতনা একটি নির্যাতিত, নিষ্পেষিত জাতিকে পরিবর্তন করে আত্মনির্ভর ও স্বাধীন জাতিসত্তা উপহার দিতে পারে। ১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায় বিচার, এ সব চেতনাকে সামনে রেখে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন বৈষম্যহীন স্বনির্ভর, স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি জাতির। তাদের সে স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেটিই ভাববার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু অসাধু রাজনীতিবীদদের স্লোগানেই সীমাবদ্ধ ছিল। এতদিন যাবৎ অনেকে এটিকে লুটপাট, ক্ষমতা দখল, আর দুর্নীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। জনগণ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ভাববার সামান্য ফুরসত কোথায়? রাজনীতিবিদরা নিজের আখের গুছাতে ব্যস্ত ছিলেন! যখন মধ্যপ্রাচ্য ও বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ পরিস্থিতি অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। তদুপরি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ইউরোপের মতো বাংলাদেশকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। তখন দেশের নেতৃবৃন্দ মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগান তুলে বিদেশে সম্পদ ও বাড়ি তৈরি করে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত ছিলেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। রিজার্ভ সংকটের কারণে ব্যাহত হয়েছে আমদানি। আর নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দেশকে একটি তাঁবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তবে ছাত্র জনতার বিপ্লবের পর জনগণ আবার আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনতে জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। দূর্ণীতিকারীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ বেড়েছে। তাছাড়া ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মধ্যে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে কায়োকফু বন্দর থেকে কুনামিং অবধি চীনের তেল গ্যাস পরিবহনের পাইপলাইন, রাখাইনে ভারতের সহায়তায় তৈরি কালাদান বহুমুখী ট্রানজিট-ট্রান্সপোর্ট প্রোজেক্ট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ইন্দ-প্যাসিফিক অঞ্চল ইত্যাদি কারণে বিশ্ব পরাশক্তিধর দেশগুলোর নিকট বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠায় সবাই সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। এমতাবস্থায় প্রয়োজন নিজেদের স্বতন্ত্র নীতির উপর ভিত্তি করে দেশের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা কাজে লাগানো। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি শক্তিশালী এবং ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকলে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে যেমনিভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, তেমনিভাবে দুর্বল নেতৃত্ব ও দুর্নীতিবাজ, উদরপূর্তিকারী নেতৃত্বের কারণে ইউক্রেনের ন্যায় বলির পাঁঠা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন সাহসী ও শক্তিশালী নেতৃত্ব যারা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে দেশ ও জনগণের কল্যাণে ভিনদেশিদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারবেন। অথচ বিভিন্ন সময়ে আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ আপন ক্ষমতার স্থায়িত্ব বা ক্ষমতা গ্রহণের আশায় পরাশক্তিদের সঙ্গে দর কষাকষি করছেন। ফলে ভিনদেশি প্রভুরাই বাংলাদেশ থেকে সুবিধা আদায় করেছে।
অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি ইত্যাদি বুলি আওড়িয়ে জনগণকে বিভক্ত করছেন। ফলশ্রুতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যবহার উন্নয়নের পরিবর্তে সমাজের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর হয়ে দণ্ডায়মান হয়েছে। যা একটি জাতির জন্য কখনোই কল্যাণকর নয়। একটি জাতির উন্নয়নে যে মুল্যবোধ বা চেতনা প্রয়োজন তা আমাদের আছে, এখন প্রয়োজন সঠিক ব্যবহার। মুখে চেতনার কথা বলে তার অপব্যবহার করলে জনগণ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। পর্যায়ক্রমে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা লোপ পায়। একসময় তারা নিজেরদেরকে গুটিয়ে নেন। ফলে রাজনীতিবিদরা এবং জনগণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। যা শুধু একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই নয় বরং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারানোর অশনি সংকেত। যার স্পষ্ট প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছি।
এখন আমজনতার প্রত্যাশা সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের অধিকার বাস্তবায়ন করা। অতঃপর রাজনীতি ও জাতীয় উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত করে সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্যবিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
"