হৃদয় পান্ডে
মুক্তমত
নদীদূষণ রোধে নীতি প্রণয়ন
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ আর এই নদীগুলোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি। তবে বর্তমান বাস্তবতায়, এই পরিচয় আজ সংকটে। দেশের প্রধান নদীগুলো প্রতিনিয়তই দূষণের শিকার হচ্ছে। শিল্প-কারখানার অবৈধ বর্জ্য, পৌরবর্জ্য, প্লাস্টিক, রাসায়নিক ও নানা ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ ক্রমাগতভাবে নদীগুলোর পরিবেশগত ভারসাম্যকে নষ্ট করছে। ফলে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যে, কৃষিতে, এমনকি মানবস্বাস্থ্যে। বাংলাদেশের নদীমাতৃক পরিচয় এভাবে চলতে থাকলে কেবলই ইতিহাসে পরিণত হতে পারে। তাই এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি সুসংহত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের নদীগুলোর দূষণের প্রধান উৎস হলো শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য। অধিকাংশ কারখানাই তাদের বর্জ্য পরিশোধন না করেই সরাসরি নদীতে ফেলে দেয়। এসব বর্জ্যে থাকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ, যা নদীর পানিকে বিষাক্ত করে তোলে। ফলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীববৈচিত্র্যে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে গার্মেন্ট, ট্যানারি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প থেকে নির্গত দূষিত পানি নদীর পানিকে ব্যাপকভাবে দূষিত করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এসব দূষণ নদীর ইকোসিস্টেমকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শিল্পবর্জ্যরে পাশাপাশি পৌরবর্জ্য, প্লাস্টিকের বর্জ্য ও কৃষি কাজে ব্যবহৃত রাসায়নিকও নদীদূষণের অন্যতম কারণ। শহরের সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকার ফলে অসংখ্য পৌরবর্জ্য সরাসরি নদীতে চলে আসে। এ ছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য দীর্ঘদিনেও মাটির সঙ্গে মিশে না, ফলে নদীতে এর প্রভাব স্থায়ীভাবে থেকে যায়। এভাবে চলতে থাকলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং জলজ প্রাণী খাদ্যাভাবে বা প্লাস্টিকের জটিলতায় মৃত্যুবরণ করে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে উঠছে, যা শুধু জীববৈচিত্র্য নয়, বরং মানুষের পানীয়জলের উৎসকেও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
নদীদূষণ প্রতিরোধে একটি সুসংহত নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন, যা নদীগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক হবে। তবে শুধু নীতি প্রণয়নই যথেষ্ট নয়; এ নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন ও তদারকি নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। নীতিমালায় শিল্প-কারখানাগুলোকে বর্জ্য পরিশোধন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই নদীতে ফেলার অনুমতি না দেওয়ার কঠোর বিধান থাকতে হবে। যারা এই আইন লঙ্ঘন করবে, তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এতে করে কারখানা মালিকদের মধ্যে আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি হবে এবং নদীর দূষণ কমবে।
এ ছাড়া, দূষণ রোধে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদীর তীরবর্তী এলাকার জনগণকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। এর পাশাপাশি বিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষার্থীদের নদীদূষণের কুফল সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হয়। কমিউনিটি প্রোগ্রাম ও প্রচারণা কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে, যা দূষণ রোধে দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনতে সক্ষম।
নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি বিশেষায়িত নদী তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যা নদীগুলোর পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে। এর মাধ্যমে নদীর পানির গুণগত মান, দূষণমাত্রা এবং নদীর তীরে জমে থাকা বর্জ্যরে অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। তদারকি ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে এবং দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব হবে।
নদীর সুরক্ষায় টেকসই ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। উন্নত দেশগুলোতে এখন বর্জ্য পরিশোধন প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নদীদূষণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। বাংলাদেশেও এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দূষণ রোধ করা যেতে পারে। শিল্প-কারখানাগুলোয় অত্যাধুনিক বর্জ্য পরিশোধন প্রযুক্তি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া উচিত, যাতে নদীতে দূষণ কমে আসে এবং পরিবেশ রক্ষিত হয়।
নদীর জীবন ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন, সরকার ও জনগণের মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও এই আন্দোলনে অংশ নিতে হবে। নদীর পরিচ্ছন্নতা ও সুরক্ষায় তাদের সমর্থন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে এটি একটি ব্যাপক সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গণমাধ্যম নদীদূষণের প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে পারে এবং নীতিমালা বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরতে পারে।
নদী বাংলাদেশের মানুষের জীবিকা, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এ দেশের কৃষি, মৎস্যশিল্প এবং পরিবহনব্যবস্থা নদীর ওপর নির্ভরশীল। তাই নদীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। একটি সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীদূষণ রোধ করা সম্ভব। এভাবে চললে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটি দূষণমুক্ত পরিবেশ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের নদীগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং এর জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ
"