মো. তারেকুল ইসলাম
দৃষ্টিপাত
শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক পুলিশে নিয়োগ ও প্রসঙ্গ কথা
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক নয়া বাংলাদেশের বিনির্মাণ হয়েছে এবং এর কাজ চলমান রয়েছে। অসীম সাহসী জেনারেশন জুমারখ্যাত শিক্ষার্থীরা ড্রাইভার হয়ে স্টিয়ারিং ধরে এই বঙ্গভূমি মেরামতের দায়িত্ব হাতে নিয়েছে। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েই তারা শুধু বসে থাকেনি। বরং বাংলাদেশ সংস্কারের প্রত্যয় ব্রত সামনে নিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে এই তরুণ সমাজ আমভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তারই অংশ হিসেবে শুরুতেই তারা ট্রাফিক পুলিশের মহান দায়িত্ব পালন করার কাজে হাত দেয়।
এদিকে, ৬ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত টানা এক সপ্তাহ পুলিশ প্রশাসন কর্মবিরতিতে ছিল। ঠিক সে সময়ে সড়কের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সড়ক ও মহাসড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে অভূতপূর্ব সরব অবস্থান ছিল। সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা দেখে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসায় ভেসেছে প্রশিক্ষণবিহীন এই জেনজি। সপ্তাহখানেক তাদের কাজ এত বেশি সাড়া ফেলেছিল যে, শিক্ষার্থীদের ট্রাফিকে খণ্ডকালীন চাকরি দেওয়ারও দাবি ওঠে।
গত ১৮ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে শিক্ষার্থীদের ‘সুষ্ঠুভাবে ট্রাফিক কন্ট্রোল ও নিরাপদ সড়কের দাবি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বেসরকারি সংস্থা রিফর্ম বাংলাদেশ লিজেন্ট অ্যান্ড সেফ মোবিলাইজেশন (আরবিআরএসএম) ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় করণীয় সুপারিশ এক অনুষ্ঠানে এ দাবি করা হয়। এদিকে, ২১ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ডিএমপির ‘ট্রাফিক পক্ষে’র কার্যক্রমে প্রাথমিকভাবে ৩০০ শিক্ষার্থীকে সম্মানীসহ যুক্ত করা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পত্রিকায় অনেকে লেখালেখির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক পুলিশে ঘণ্টাভিত্তিক কাজে নিযুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। এদিকে, প্রয়োজন অনুপাতে সারা দেশে ট্রাফিক পুলিশের জনবলও কম। এ ক্ষেত্রে প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, রাজস্ব খাতের ৪৩ শতাংশ টাকা ব্যয় হয় পরিচালনা বাবদ। নতুন করে জনবল নিয়োগ দিলে পরিচালনা ব্যয় বাবদ যে খরচ হবে তা রাষ্ট্র সামাল দিতে পারবে না। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে ১৮ বছর ঊর্ধ্ব শিক্ষার্থীদের পার্ট টাইম ট্রাফিক পুলিশের কাজে নিয়োগদানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও শিক্ষার্থী উভয়ই উপকৃত হবে।
এ ছাড়া আগস্টে সপ্তাহখানেক ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও অবদান প্রমাণ করে তারা এ কাজে মোটেও অপ্রস্তুত ও অযোগ্য নয়। তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে সড়ক শৃঙ্খলায় অংশীদার হলে সড়কের পরিবেশ উন্নত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আয়-রোজকারের ব্যবস্থা হবে। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২৩-এর তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে। এদিকে, বিশ্ব জরিপ সংস্থার মুখপাত্র সাইয়্যিদ মুহম্মদ আকতার ই-কামাল বাংলাদেশের জনসংখ্যা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়েছে। সেই হিসাব বিবেচনায় আনলে শহরে জনসংখ্যার পরিমাণ ৩১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। অথচ, সেই অনুপাতে ট্রাফিক পুলিশ রাজধানীতে ও বিভাগীয় শহরগুলোয় নেই।
জাতীয় দৈনিক বায়ান্ন পত্রিকার এ মাসের ২৭ তারিখের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে রাজধানীতে ট্রাফিক বিভাগের জনবল ৩ হাজার ৮৯৩ জন।
বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে সার্জেন্ট রয়েছেন ৭১১ জন। চাহিদার তুলনায় এখনো ২০০ সার্জেন্ট কম নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন ট্রাফিক সদস্যরা। সংখ্যায় কম রয়েছে টিএসআই ও কনস্টেবলও। সব মিলিয়ে আরো ১২০০ জনবল দরকার ডিএমপিতে। অথচ প্রথম আলো ৫ এপ্রিল ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২১ সময়ে রাজধানীতে মোটরসাইকেল বেড়েছে প্রায় আট গুণ। সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ লাখে। একই সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮০৯টি, যা ২০১০ সালে ছিল ১ লাখ ৭৮ হাজার। একই সঙ্গে উল্লেখ্য, সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৫ জন অধিবাসী রয়েছে, যা মোট সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার ২৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
এদিকে, দেশের জনসংখ্যা যখন জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে, ঠিক তখন রাজধানীতে ১০০০ কনস্টেবল এবং ২০০ সার্জেন্ট কম নিয়েই পরিচালিত হচ্ছে ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ। পরিতাপের বিষয় হলো, জনবল সংকটের বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরে জানানো হলেও নতুন নিয়োগের সুরাহা এখনো হয়নি। কিন্তু অন্যদিকে আশার দিক হলো, সম্মানীসহ ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ৩০০ শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা হয়েছে। ২১ অক্টোবর ডিএমপির ট্রাফিক পক্ষের আয়োজনে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম পুলিশে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনায় রেখে নিয়োগ প্রক্রিয়া গ্রহণ করলে শিক্ষার্থী ও দেশ উপকৃত হবে।
প্রথমত, জাতিসংঘের বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসূচক-২০২৪ অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র?্যসীমার ভেতর বসবাস করছে। চরম দারিদ্র্যের সংজ্ঞায় বিশ্বব্যাংক বলছে; যাদের দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯০ ডলার, তারা চরম দারিদ্র?্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের হতদরিদ্রও বলা যায়। কাজেই, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দিয়ে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে সরকার তালিকা সংগ্রহ করতে পারে। যেসব শিক্ষার্থী দারিদ্র?্যসীমার নিচে বসবাস করছে, এমন হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের অনাগত ট্রাফিক পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিক বিবেচনা করবে।
দ্বিতীয়ত, যেসব ১৮ ঊর্ধ্ব শিক্ষার্থী গৃহশিক্ষক হিসাবে কাজ করে না, এমনতর বিদ্যার্থীদের অধিকতর বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। অধিকন্তু, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় কলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা গৃহশিক্ষক হিসেবে খুব কম প্রাধান্য পেয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পার্টটাইম ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগে কলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকারে রাখা যেতে পারে। তবে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী যারা পড়ালেখা ব্যতিরেকে টিউশন বা অন্য কোনো পার্টটাইম কাজে জড়িত নেই, তাদের সরকার চিন্তা করতে পারে।
তৃতীয়ত, জেলা শহুরে নিয়োগের বিষয়টা আসলে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিবেচনা করা যুক্তিযুক্ত। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অনেকে জেলা সদরে উচ্চমাধ্যমিক কলেজে পড়তে আসে। অনেক ছাত্রছাত্রী অর্থনৈতিক কারণে ম্যাস কিংবা বাসাভাড়া করে থাকতে পারে না। আবার গ্রাম থেকে কলেজের দূরত্ব বেশি হওয়ায় প্রতিদিন গাড়িভাড়া দিয়ে ক্লাস করতে আসাও অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তাদের সঠিকভাবে লেখাপড়া দারুণ বিঘ্ন ঘটে।
এই ক্ষেত্রে বেছে-বেছে জেলা সদর কলেজে উচ্চমাধ্যমিকপড়ুয়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিবেচনাধীন নিয়ে পার্টটাইম ট্রাফিকে নিয়োজিত করলে তারা যেমন আর্থিকভাবে উপকৃত হবে, তেমনি জেলা সদরে থেকে-খেয়ে লেখাপড়াও চলমান রাখতে পারবে।
চতুর্থত, যেসব শিক্ষার্থী ৬ থেকে ১২ আগস্ট এবং তৎপরবর্তী বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশের পরিপূর্ণ কাজে যোগদানের আগ পর্যন্ত যেসব শিক্ষার্থী ট্রাফিক পুলিশের মহান দায়িত্ব পালন করেছে, সরকার তাদের প্রাধান্য দেবে বলে আশা করা যায়। এ ক্ষেত্রে দেশের দুঃসময়ে দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষার্থীদের যারা দরিদ্র ও মেধাবী তাদের সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
উল্লিখিত পরামর্শের বাইরে সরকারের আরো অধিক পরিকল্পনা সঙ্গে নিয়ে বাছাই প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে ট্রাফিক পুলিশে নির্দিষ্ট ঘণ্টায় মেয়াদভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারে। নিয়োগ পূর্বে তাদের ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ স্বাভাবিকভাবেই প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। নিয়োগ পেয়ে তারা ট্রাফিক শৃঙ্খলায় কাজ করে অভিজ্ঞ হয়ে যাবে। নির্দিষ্ট মেয়াদে পার্টটাইম চাকরি শেষ করার পর ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ তাদের সনদের ব্যবস্থা করতে পারে এবং যখন কনস্টেবল ও সার্জেন্ট নিয়োগ করা হবে, তখন সনদধারীদের প্রাধান্য দেওয়ার বিধিও স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ বিভাগ রাখবে। ফলে, পুলিশ বিভাগ প্রশিক্ষিত রেডিমেইড কিছু অফিসার ও কনস্টেবল পেয়ে যাবে। একই সঙ্গে তাদের প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ বাবদ সরকারের ব্যয়ও কমে আসবে। কাজেই সার্বিকভাবে বলা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার উল্লিখিত বিষয় বিবেচনায় রেখে শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক পুলিশে নিয়োগ করে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"