মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
মতামত
ইলিশের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের শতকরা ৭৫ ভাগই আহরণ করে বাংলাদেশ। বিগত ১২ বছরে মোট মাছের উৎপাদন ১ দশমিক ৫ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছে ৫ দশমিক ৬৫ লাখ টন, যা ছিল বিগত ১২ বছরের ইলিশ উৎপাদনের ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি। বর্তমান ইলিশের মৌসুমে শুধু কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়। এত কিছুর পরও ইলিশের দাম কখনোই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে না। বছর জুড়ে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া থাকার পেছনে রয়ে গেছে কিছু অনৈতিক কার্যকলাপ। দেশের প্রধান ইলিশের প্রাপ্তিস্থান থেকে জেলাপর্যায়ের পাইকারি বাজারের আড়ত পর্যন্ত আসতে শুরু হয় মূল্যবৃদ্ধির কারসাজি।
পর্যবেক্ষণ বলছে, আড়তে তিন শ্রেণির ব্যবসায়ীর হাতবদল হয় ইলিশের। তাতে কেজিপ্রতি ইলিশের দাম বেড়ে যায় দ্বিগুণ। এক হাজার টাকা কেজির মাছ হয় দুই হাজার টাকা। এ বছর তো এক কেজি সাইজের ইলিশ ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আড়তের নিলাম থেকে ইলিশ কিনে নেন পাইকাররা। পাইকারদের কাছ থেকে মাছ কিনে ফুটপাতে বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা। আবার সেখান থেকে মাছ চলে আসে খুচরা বিক্রেতার হাতে, তারপর ভোক্তার কাছে। এত হাতবদলে মুনাফার পাল্লা ভারী হয়। লাভের খেসারত দিতে হয় ভোক্তাদের। যারা ইলিশের ব্যবসা করেন তারা লাভ অবশ্যই করবেন। তবে তার একটা মাত্রা থাকা দরকার। যেখানে কেজিপ্রতি মাছে ২০ থেকে ৩০ টাকা লাভ করলেই চলে, সেখানে ১০০ টাকা বা তারও বেশি লাভ নিয়ে বিক্রি করা মাছ সাধারণ মানুষকে ইলিশ কিনে খেতে হয়। সারা বছরই বাজারে কমবেশি ইলিশ পাওয়া গেলেও দাম কখনো সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আসে না।
ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের জন্য মা ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে। প্রতি বছর এ সময়ে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে সারা দেশের ৩৮ জেলায় নদীতে জাল ফেলা, ইলিশ শিকার, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মজুদ ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে মে থেকে জুলাইয়ে ৬৫ দিনের জন্য ৯ ইঞ্চির ছোট ইলিশ (জাটকা) ধরার নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসা হয়। মাছের প্রজননকালীন সময়ে সাগর ও নদী মোহনায় মাছ শিকার বন্ধ রাখা হলে ইলিশ দ্রুত বংশবিস্তার লাভ করে। গবেষণা বলছে, মা ইলিশের পাড়া ডিমের অর্ধেক যদি নিষিক্ত হয় এবং তার মধ্যে ১০ শতাংশ যদি বেঁচে থাকে, তবে ৩৭ হাজার কোটি পোনা ইলিশ পাওয়া যায়। মা ইলিশ রক্ষা করা গেলে ওরা ডিম পাড়ার সুযোগ পায় এবং এই ডিম নিষিক্ত হয়ে যে জাটকার জন্ম হয় পরে তা বড় ইলিশে রূপ নেয়। একটা মা ইলিশ সাধারণত চার থেকে পাঁচ লাখ ডিম ছাড়ে। মা ইলিশ ধরা বন্ধ রাখলে নদীর বিশাল জলরাশি ইলিশের ডিমে পূর্ণ হয়ে যায়। ৯ ইঞ্চির ছোট আকারের ইলিশ জাটকা নিধন বন্ধ রাখা গেলে তা কোনো পরিচর্যা ছাড়াই দ্রুত বেড়ে উঠে একটি পূর্ণ আকারের ইলিশে রূপ নেয় এবং এর একেকটির ওজন হতে পারে দুই কেজি বা তারও ঊর্ধ্বে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ চলাকালে বাজারে ইলিশ বিক্রি তেমন দেখা না গেলেও নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে না। জেলেরা আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীতে ইলিশ ধরে এবং লুকিয়ে নদীতেই ইলিশ বিক্রি করে দেয়। কখনো বাজারেও এসব ইলিশের দেখা মেলে। দায়িত্বরত কোস্টগার্ডরা মঝেমধ্যে ইলিশ শিকার বন্ধে চালানো অভিযানে কিছু জেলেকে আটক করে এবং অর্থদণ্ড দেয়। চতুর ব্যবসায়ীরা ইলিশ আহরণের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ধরা ইলিশ মজুদ রেখে পরে তা বাজারে বিক্রি করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান অপরিসীম। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২ শতাংশ ইলিশ। এ ছাড়া ইলিশ দেশের জিডিপিতে ১ শতাংশ অবদান রেখে চলেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত চার বছরে ভারতে ৫৪১ টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, যা মোট ইলিশ উৎপাদনের মাত্র দশমিক ৫ ভাগেরও কম। এ বছরেও সামান্য পরিমাণ ইলিশ ভারতে রপ্তানি হয়েছে। ইলিশ উৎপাদনের তুলনায় রপ্তানি করা ইলিশের পরিমাণ কম হলেও বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশের দেখা নেই। দেশে ইলিশের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় ইলিশের দাম থাকে আকাশছোঁয়া। রপ্তানি করা ইলিশের বাইরেও অবৈধ পথে কিছু ইলিশ দেশের বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এসে অন্য দেশের জেলেদের ইলিশ ধরার অভিযোগ রয়েছে। এসব অনিয়ম বন্ধ না করা হলে দেশ রাজস্ব হারাবে, আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে। জাটকা নিধন বা মা ইলিশ ধরা বন্ধ রেখেও কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে প্রথম অবস্থানে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫ দশমিক ৭১ লাখ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়, যেখানে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২ দশমিক ৯৯ টন। আগামী অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০২১-২৫) মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মৎস্য ও মৎস্যপণ্য রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ এবং জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মৎস্য ব্যবসায়ী, আড়তদাররা যাতে অন্যায়ভাবে মাছের দাম বাড়াতে না পারে, তার জন্য বাজার মনিটরিং অব্যাহত রাখতে হবে। অতি মুনাফালোভী ইলিশ ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে দণ্ড নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তাদের মতে, সংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয় তাদের দায়িত্ব পালনে যত্নশীল হলে বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ মিলবে এবং ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে।
দেশে প্রায় পাঁচ লাখ জেলে সরাসরি ইলিশ আহরণের সঙ্গে জড়িত। তা ছাড়া ইলিশ পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ। ইলিশ ধরার নিষিদ্ধকালীন সময়ে জেলেরা বেকার হয়ে পড়ে এবং পেটের দায়ে তারা জাটকা ও মা ইলিশ শিকার করতে বাধ্য হয়। অভয়াশ্রম এলাকায় মৎস্য আহরণে বিরত থাকা নিবন্ধিত জেলেদের প্রতি মৌসুমে ভিজিএফ চাল সহায়তা দেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু তালিকার বাইরে থাকা প্রণোদনাবঞ্চিত জেলেরা কোনো সহায়তা না পাওয়ায় পড়েন সংকটে। নদীতে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞাকালে এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণে যেসব জেলে সাগরে মাছ ধরতে ব্যর্থ হয়, তারা দাদনের ঋণই শোধ করতে পারে না। জেলেদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। দেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মা ইলিশ এবং জাটকা নিধন বন্ধ নিশ্চিত করতে কোস্টগার্ডের সংখ্যা এবং সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে নদ-নদীর পানিদূষণ রোধ করতে হবে। সাধারণত ১০ মিটার গভীর পানিতে বড় ইলিশ অবাধে চলাচল করতে পারে। কম গভীরতার পানিতে বড় ইলিশ খুব একটা আসে না। এ জন্য নদীর নাব্য বাড়িয়ে তুলতে হবে।
ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে মৎস্য অধিদপ্তর পাঁচটি অভয়াশ্রম তৈরি করে। ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোয় সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার জারি রয়েছে। আইন অমান্যকারীদের কমপক্ষে এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু মৎস্যজীবীদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে অনেক সময় তাদের জন্য এ ধরনের দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয় না। জাটকা এবং মা ইলিশ নিধন বন্ধে জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আপৎকালীন সময়ে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি দেশে মৎস্যসম্পদ বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। মৎস্যজীবীরা যাতে ইলিশ ব্যবসায়ী মহাজন, আড়তদারদের অতি মুনাফার লোভের শিকার হয়ে আর্থিক দুর্দশায় পড়ে মানবেতর জীবন করতে না হয়, সে দিকে নজর দিতে হবে। আজকাল খালবিলে এবং নদী-নদীতে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। বাজারে ডিম, মুরগি, গরু-খাসির মাংসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমিষের এসব উৎস নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। কাজেই বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া গেলে এবং এর মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা গেলে মানুষ ইলিশ খেয়ে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। ইলিশের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশের বর্তমান নদ-নদীর পানি প্রবাহ, জলজ পরিবেশ ও আবহাওয়ার পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ইলিশ উৎপাদন, আহরণ, বাজারজাতকরণ এবং বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
"