শতদল বড়ুয়া
মুক্তমত
বিলাসীর কাতারে শামিল প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কোনোভাবে আপস মানতে চায় না। আগে মানুষ দুটি জিনিসের মূল্য বিষয়ে ভাবত। সেগুলো হলো পেঁয়াজ এবং কাঁচা মরিচ। অনেকে আগেভাগে কিনে সংরক্ষণ করত। এ বছর তা কিন্তু হয়নি। পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও কাঁচা মরিচের মূল্য প্রতিদিনই বাড়ছে। বর্তমানে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ডিম। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নিলেও এখনো সাধারণ জনগণ দিশাহারা। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো তরকারির দাম ১০০ টাকার ওপরে। এ অবস্থায় বেশি বেকায়দায় আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকরা। তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তাল মেলাতে পারছে না।
যাক আমার প্রসঙ্গ ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিযয়ে। বাজারে গিয়ে মানুষ হতবম্ভ হয়ে যাচ্ছে। সবকিছুর দাম আগের চেয়ে কয়েক গুণ বৃদ্ধি। বাজার পরিদর্শনে গেলাম। নিজেরও কিছু সওদাপাতি আছে। একজন আরেকজনকে বলছে, কিরে ভাই! এভাবে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন? লোকটি বলল, বাজারে দ্রব্যমূল্যের চরিত্র পাল্টে গেছে। আজ বাজারে এসে দুশ্চিন্তায় ভুগছি। মাছ ছোট-বড় কোনো কথা না, কোনো মাছ ২০০ টাকা কেজির নিচে নেই। আনুপাতিক হারে সবকিছুর দাম আপসহীন গতিতে চলছে। আগে ১০০ টাকায় তিন কেজি পেঁয়াজ পেলেও বর্তমানে সেই পেঁয়াজ কেজি ১১০-১২০ টাকা। কাঁচা তরকারিও ওই একই পথের যাত্রী। একমাত্র আলু ছাড়া অন্য সবকিছুর মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। আলুর দামও কেন জানি নড়ে-চড়ে বসেছে। মুরগির মূল্যও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। বাজার নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণহীন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশি বেকায়দায় পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। অভিজাত শ্রেণির মানুষ বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। নিম্নশ্রেণির মানুষ নো চিন্তা, ডু ফুর্তিতে আছে। ইতিহাসের আলোকে বলতে চাই, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মধ্যবিত্ত সমাজের জ্ঞান সাধনা, কর্মসাধনা ও ভাব সাধনার গৌরবে রচিত হয়েছিল এই দেশের উজ্জ্বলতম ইতিহাস। মধ্যবিত্ত সমাজ ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের সৃষ্টি। লর্ড মেকলের পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রিটিশ বাণিজ্য এবং শনিচক্রের সমর্থক একদল প্রভাবশালী যুবক সৃষ্টির মাধ্যমে এই সমাজের উদ্ভব। এ দেশে নতুনতর সমাজ বিন্যাস শুরু হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধের সূচনা থেকে। এই যুদ্ধের রাক্ষুসে দাবিতে শিল্প বাণিজ্যের নানা সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। যার কারণে কেউ ধনী, কেউ দরিদ্র হয়েছে। আজ সমাজের একদিকে মেহনতি মানুষ, অন্যদিকে বিলাসী ধনিক। দ্বিধাবিভক্ত সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্থান কোথায়? এরা ধনী শ্রেণিভুক্ত নয়, পরিশ্রমীজীবীও নয়। এরা আত্মশ্রমে আপনাতে আপনি বিকশিত। কিন্তু সেই শ্রম কোনো দৈহিক শ্রম নয়, মানসিক শ্রম। তাই এরা মস্তিষ্কজীবী, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। বর্তমানের এ চড়া বাজারে মধ্যবিত্তরা প্রবেশ করতে পারছে না। মাসিক বেতন, মাসিক রোজগার সীমাবদ্ধের গণ্ডি পেরোতে পারছে না। নীরবে-নিভৃতে চলছে মূল্যবৃদ্ধির গোপন ঘাতক। মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে ঠিকই, মধ্যবিত্তরা অর্থসংকটে পড়ে অস্থির দিন যাপন করছে।
এবারের মতো নিত্যপ্রয়োনীয় জিনিসপত্রের মূল্য আগে কখনো বাড়েনি। বিক্রেতারা বলছেন, আমরা আড়তে মাল পাচ্ছি না, যৎসামান্য যা আসে তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার অনেক ঊর্ধ্বে। আমরাও বেশ সংকটে আছি। আয় নেই, ব্যয় থামাতে পারছি না। একশ্রেণির মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ রয়েছে। তারা জিনিসপত্রের দাম নিয়ে এত মাতামাতি করে না, বিক্রেতা যা মূল্য চায় তা দিয়ে কিনে নিয়ে যায়। উপস্থিত একজনের এ মন্তব্য অন্যরা মানতে নারাজ। গাছ যেমন বড়, তার বাতাসও তেমন বেশি। যাক আমরা এ বিতর্কে যেতে চাই না। প্রকৃতি আমাদের তেমন সহায়ক নয় বলে চারদিকে মূল্যবৃদ্ধির মহড়া চলছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আরে জানা যায়, মূল্যবৃদ্ধির লাগাম এখনো থামানো যাবে না। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট হচ্ছে। সাগরের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বাজারে গেলে বোঝা যায় কীভাবে দ্রব্যমূল্য অস্থিরতায় রয়েছে। আনুপাতিক হারে কোনো দ্রব্য বাকি নেই দাম বাড়েনি।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সদা সতর্ক থাকা সত্ত্বেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তবু আমরা আশায় বুক বাঁধি, এ সংকটের আয়ু অতি কম। নিয়মি ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। মানুষের শ্রেণিভেদের কথা না ভেবে সবাইকে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। সরবরাহ পর্যাপ্ত হলে আপসহীন মূল্যবৃদ্ধি আপনা-আপনি ধরাশায়ী হয়ে যাবে... এ মন্তব্য করলেন এক অর্থনীতিবিদ। আমরাও তার সঙ্গে একমত পোষণ করছি। আরো আশা করছি, প্রকৃতি যেন আমাদের সহায়ক হয়।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
"