অলোক আচার্য
দৃষ্টিপাত
জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধে ধীরগতি প্রসঙ্গে
আজ থেকে ২০০ বছর আগে ব্রিটেনে শুরু হয়েছিল শিল্পবিপ্লব। এই শিল্পবিপ্লবের মূলে ছিল কয়লা। বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে কয়লা। গত বছর জলবায়ু সম্মেলনে দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে একটি খসড়া চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সামনে আরেকটি জলবায়ু সম্মেলন। এর আগেই একটি চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটেন থেকে যে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়, সেখান থেকেই নতুন পথের যাত্রা শুরু হয়েছে। ২০০ বছর আগে যে দেশে শিল্পবিপ্লব হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে সেখানে কয়লা যুগের অবসান ঘটতে চলেছে। কয়লার বদলে দেশটি প্রাকৃতিক গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ধনী দেশগুলোর বৈশ্বিক ক্লাবের মধ্যে ব্রিটেনই প্রথম কয়লা থেকে সরে আসছে। ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ডে বিশ্বের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের গতি মন্থর করার চেষ্টায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম একটি মাইলফলকে পৌঁছাচ্ছে যুক্তরাজ্য। অন্য জি-সেভেন দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ২০২৫ সালের মধ্যে, কানাডা ২০৩০ সালের মধ্যে এবং জার্মানি ২০৩৮ সালের মধ্যে কয়লা থেকে সরে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে। ওইসিডিভুক্ত ৩৮টি দেশের তিন-চতুর্থাংশও ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লা থেকে সরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও কয়লা থেকে সরে যাচ্ছে, তবে সেই গতি পরিবেশবাদীদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ধীর। সিকি শতাব্দী আগে দেশটির অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো কয়লা থেকে; এখন এ হার প্রায় ১৮ শতাংশ।
আমাদের মূল লক্ষ্য তাপমাত্রা কমানো। কিন্তু সেই তাপমাত্রা আদৌ কমছে না। বরং গবেষণা আরো ভয়ংকর তথ্য দিচ্ছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারলে শতাব্দী শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৩ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির পরিবেশ কর্মসূচির একটি বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। এই বৃদ্ধি রোধে উন্নত দেশগুলো দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৭৭ শতাংশের জন্য উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০-কে দায়ী করেছেন প্রতিবেদনটির প্রধান বৈজ্ঞানিক সম্পাদক অ্যান ওলহফ। তিনি বলেন, আমরা যদি ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রগতির দিকে তাকাই, বিশেষ করে জি-২০ সদস্য দেশগুলো, তারা ২০৩০ সালের জন্য বর্তমান জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে খুব বেশি অগ্রগতি করতে পারেনি। জাতিসংঘ বলেছে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ রোধে বর্তমানে যেসব নীতি বা বিধি রয়েছে, সেগুলোর আওতায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব হয়ও, তবু ২১০০ সালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ দশমিক ৬ থেকে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়তে থাকলেও এখনো বিশ্বের জ্বালানির প্রায় ৮০ শতাংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। পৃথিবীর জলবায়ু কেমন বা কোন পরিস্থিতিতে রয়েছে, সে নিয়ে বিজ্ঞানীদের সতর্কবাণী রয়েছে। তবে নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, আজকের যুগে মানুষের কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের যে মাত্রা রয়েছে, তা এর আগে সবশেষ দেখা গিয়েছিল ১ কোটি ৪০ লাখ বছর আগে। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় কোটি ৬০ লাখ বছর আগে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
১৯৯২ সালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে (ইউএনএফসিসিসি) স্বাক্ষর করে। তারপর থেকে, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন (সিওপি) প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে আলোচনা করা হয় যে ঠিক কীভাবে এটি কমিয়ে আনার উপায় অর্জন করা উচিত এবং কী অগ্রগতি হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করা। বাংলাদেশ ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মিসরে হওয়া ‘কপ-২৭’-এর সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি ‘ক্ষতি ও লোকসান’ তহবিল সৃষ্টি করা। আর কপ-২৮-এ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ুভিত্তিক প্রকল্পগুলোয় অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি করতে এই সম্মেলনে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি নতুন বেসরকারি বিনিয়োগ তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আলতেরা’। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এই তহবিলে অর্থায়ন করবে। পরিবেশদূষণ মোকাবিলায় আরো কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জলবায়ু দূষণ মোকাবিলায় পারমাণবিক শক্তির তিন গুণ বৃদ্ধির চেয়ে একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে ২০টিরও বেশি দেশ। ২০২০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমনের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা করাতে চায় তারা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপের দেশ রয়েছে এই তালিকায়। কার্বন ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের অবস্থা আগের চেয়ে আরো বেশি খারাপ হচ্ছে। ২০২৩ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানীরা জানান, এই নির্গমনের পরিমাণ এই বছর ৪০ দশমিক ৯ গিগাটনে গিয়ে পৌঁছাবে। ২০১৫ সালের আগে বিভিন্ন দেশ এবং বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও একত্রে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। জ্বালানির বড় অংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। স্বাভাবিকভাবে এই সম্মেলন ঘিরে পৃথিবীর প্রত্যেকেই আগ্রহ থাকে। কারণ এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তন।
জলবায়ু পরিবর্তন কোনো একক ইস্যু নয় যে তা এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তবে এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোই বেশি। এর ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশও। এডিবির তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের বার্ষিক গড় ক্ষতি প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৪০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (২০২৩-৫০) বাস্তবায়ন ও জলবায়ুকেন্দ্রিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অর্জনে এই ঋণ অবদান রাখবে বলে মনে করে সংস্থাটি। বিশ্বের যেসব দেশের কারণে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের সেখান থেকে বেরিয়ে টেকসই পরিবেশ গড়ায় মনোযোগী হতে হবে। শিল্পের জাঁতাকলে পৃথিবীর অবস্থা আজ অত্যন্ত দুর্বিষহ। শুধু উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পৃথিবীর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে, তা থেকে পরিত্রাণের উপায় না খোঁজাটা বড় ধরনের বোকামি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবী প্রাণিকুলের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। টিকে থাকা রীতিমতো হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। জলবায়ু স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে ২৮তম জলবায়ু সম্মেলন ছিল
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্ব তাকিয়ে ছিল বিশ্বনেতাদের দিকে যে তারা পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করার জন্য কী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা দেখারা জন্য। যদি তারা এবারও ব্যর্থতার পরিচয় দেন বা অসহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করেন, তাহলে পৃথিবীর অস্তিত্ব¡ মূলত আরো বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যাবে। যেখান থেকে ফিরে আসা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। এক কথায় বলা যায়, ব্যর্থ হলে পৃথিবী নামক এই গ্রহের ধ্বংস অনিবার্য। তখন হয়তো বিলুপ্তি খাতায় মানুষের নামও উঠে যাবে।
সুতরাং ব্যর্থতা নয়, চাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। নভেম্বর মাসেই আজারবাইজানের
রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হবে কপ-২৯। এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা রোধে বিশ্বনেতারা আরো ঐকমত্যে পৌঁছাবেন বলে আশা করা যায়। সেই সঙ্গে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণও দিতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
"