ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

  ০১ নভেম্বর, ২০২৪

ধর্মকথা

জুমার দিনের মর্যাদা

আজ শুক্রবার। আল্লাহতায়ালা জগৎ সৃষ্টির পূর্ণতা দান করেছিলেন এই দিনে। এই দিনেই হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে জান্নাতে একত্র করেছিলেন এবং এই দিনে মুসলিম উম্মাহ মসজিদে একত্র হয় বলে দিনটাকে ইয়াওমুল জুমাআ বা জুমার দিন বলা হয়। সপ্তাহের সেরা দিন শুক্রবার তথা জুমার দিন। এটি পৃথিবীর অন্যতম তাৎপর্যবহ দিবস। জুমা নামে পবিত্র কোরআনে একটি স্বতন্ত্র সুরা নাজিল হয়েছে। সেখানে মহান আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো ও আল্লাহকে অধিকরূপে স্মরণ করো; যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমুআ, আয়াত : ১০) আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যার ওপর সূর্য উদিত হয়েছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো জুমার দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাকে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম : ১৪১০)

জুমার দিনের গুরুত্ব : জুমার দিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আল্লাহতায়ালা জগৎ সৃষ্টির পূর্ণতা দান করেছিলেন এই দিনে। জুমার নামাজ ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে। রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতকালে কুবাতে অবস্থান শেষে শুক্রবার দিনে মদিনা পৌঁছান এবং বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে জোহরের ওয়াক্ত হলে সেখানেই তিনি জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ।

জুমার দিনের ফজিলত : আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন ফরজ গোসলের মতো গোসল করে প্রথম দিকে মসজিদে হাজির হন, তিনি যেন একটি উট কোরবানি করলেন, দ্বিতীয় সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করেন, তিনি যেন একটি গরু কোরবানি করলেন, তৃতীয় সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলেন, তিনি যেন একটি ছাগল কোরবানি করলেন। অতঃপর চতুর্থ সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে গেলেন, তিনি যেন একটি মুরগি কোরবানি করলেন। পঞ্চম সময়ে যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলেন, তিনি যেন একটি ডিম কোরবানি করলেন। অতঃপর ইমাম যখন বেরিয়ে এসে মিম্বরে বসে গেলেন খুৎবার জন্য, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যান।’ (বোখারি : ৮৮১, ইফা ৮৩৭, আধুনিক ৮৩০)

১০ দিনের গুনাহ মাফ হয় : জুমার দিনের আদব যারা রক্ষা করে, তাদের ১০ দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ভালোভাবে পবিত্র হলো, অতঃপর মসজিদে এলো, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনতে চুপচাপ বসে রইল, তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তী এ সাত দিনের সঙ্গে আরো তিন দিন যোগ করে ১০ দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে খুতবার সময় যে ব্যক্তি পাথর, নুড়িকণা বা অন্যকিছু নাড়াচাড়া করল, সে যেন অনর্থক কাজ করল।’ (মুসলিম : ৮৫৭)

জুমার আদব রক্ষাকারীর ১০ দিনের গুনাহ মুছে যায় : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার সালাতে তিন ধরনের লোক হাজির হয়। (ক) এক ধরনের লোক আছে যারা মসজিদে প্রবেশের পর তামাশা করে, তারা বিনিময়ে তামাশা ছাড়া কিছুই পাবে না। (খ) দ্বিতীয় আরেক ধরনের লোক আছে যারা জুমায় হাজির হয় সেখানে দোয়া মোনাজাত করে, ফলে আল্লাহ যাকে চান তাকে কিছু দেন, আর যাকে ইচ্ছা দেন না। (গ) তৃতীয় প্রকার লোক হলো যারা জুমায় হাজির হয়, চুপচাপ থাকে, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনে, কারো ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে আগায় না, কাউকে কষ্ট দেয় না, তার দুই জুমার মধ্যবর্তী সাত দিনসহ আরো তিন দিন যোগ করে ১০ দিনের গুনাহ আল্লাহতায়ালা মাফ করে দেন।’ (আবু দাউদ : ১১১৩)

প্রতি পদক্ষেপে এক বছরের নফল রোজা ও এক বছরের সারারাত তাহাজ্জুদ পড়ার সওয়াব অর্জিত হয় : যে ব্যক্তি আদব রক্ষা করে জুমার সালাত আদায় করে, তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে তার জন্য পুরো এক বছরের রোজা পালন এবং রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ার সওয়াব লেখা হয়। আউস বিন আউস আস সাকাফী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিন যে ব্যক্তি গোসল করে (অর্থাৎ সহবাস করে, ফলে স্ত্রী ফরজ গোসল করে এবং) নিজেও ফরজ গোসল করে, পূর্বাহ্ণে মসজিদে আগমন করে এবং নিজেও প্রথমভাগে মসজিদে গমন করে, পায়ে হেঁটে মসজিদে যায় (অর্থাৎ কোনো কিছুতে আরোহণ করে নয়), ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসে, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনে, কোনো কিছু নিয়ে খেল-তামাশা করে না; সে ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য রয়েছে বছরব্যাপী রোজা পালন ও সারা বছর রাত জেগে ইবাদত করার সমতুল্য সওয়াব।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৬৯৫৪, ১৬২১৮)

দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের কাফফারা : জুমার সালাত আদায়কারীদের জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারাস্বরূপ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পাঁচবেলা সালাত আদায়, এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা, এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজানের মধ্যবর্তী সময়ে হয়ে যাওয়া সব (সগিরা) গুনাহের কাফফারাস্বরূপ, এই শর্তে যে, বান্দা কবিরা গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে।’ (মুসলিম : ২৩৩)

জুমার দিনে দোয়া কবুল : জুমার ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময় কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন। (সহিহ মুসলিম : ৮৫২, মুসনাদে আহমাদ : ৭১৫১, আস-সুনানুল কুবরা : ১০২৩৪)

হজরত আনাস (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুমার দিনের কাঙ্ক্ষিত সময়টা হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৫৪৬০, তিরমিজি : ৪৮৯)

সুতরাং জুমার নামাজ মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। আর জুমার দিনের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। জুমার নামাজ এবং এ দিনের আমল বর্জন থেকে বিরত থাকা জরুরি। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে এ দিনের নামাজ ও আমল যথাযথ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close