হৃদয় পান্ডে
দৃষ্টিপাত
মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় আমাদের করণীয়
মানসিক স্বাস্থ্য বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। শারীরিক সুস্থতার মতোই মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো মানসিক সমস্যার প্রতি প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হয় না, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন, কর্মক্ষমতা, সম্পর্ক এবং সামগ্রিক কল্যাণের ওপর প্রভাব ফেলে। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এর অবহেলা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতির কারণ নয়, বরং এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ‘মন ভালো তো সব ভালো’ এই প্রবাদটি অনেক গভীর অর্থ বহন করে। মানসিক স্বাস্থ্য যদি ভালো না থাকে তাহলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই তার প্রতিফলন দেখা যায়, যা ব্যক্তির জীবনযাত্রা এবং সামাজিক সম্পর্ককে বিঘ্নিত করে।
মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজ : আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে একটি ভুল ধারণা বিরাজ করছে। মানসিক সমস্যাকে এখনো দুর্বল বা ব্যর্থতার লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। সমাজে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত অনেকেই সাহায্য নিতে সংকোচ বোধ করেন। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা একটি শারীরিক অসুস্থতার মতোই, যা সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে তা আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা না থাকায় অনেকেই সমস্যার প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে পারেন না। অনেক সময় সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাও মানসিক সমস্যাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। এর ফলে রোগীর অবস্থা ক্রমেই আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে। মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা ব্যক্তিরা প্রায়ই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, যা অবশেষে তাদের হতাশা এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
মানসিক সমস্যার কারণ : মানসিক সমস্যা সৃষ্টির অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। আধুনিক জীবনের দ্রুতগতির পরিবর্তন, প্রযুক্তিনির্ভরতা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, কর্মস্থলের চাপ, ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা এবং সামাজিক প্রত্যাশা- এসবই মানসিক সমস্যার পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে বেশি। চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার চাপ, শিক্ষাজীবনের অতিরিক্ত চাহিদা, ব্যক্তিগত জীবনের অনিশ্চয়তা- এসবই তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ এবং হতাশা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমের অতি ব্যবহার এবং ভার্চুয়াল জীবনের প্রভাবেও মানসিক সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজেকে তুলনা করা এবং সামাজিক স্বীকৃতির জন্য প্রতিযোগিতা করার প্রবণতা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুধু তরুণরাই নয়, বিভিন্ন বয়সের মানুষও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। পারিবারিক কলহ, সম্পর্কের জটিলতা, আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং শারীরিক অসুস্থতা বৃদ্ধি ও মধ্যবয়সি ব্যক্তিদের মধ্যে হতাশা এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা মানুষের মানসিক চাপের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। এসব সমস্যা অবহেলা করা হলে তা ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করে এবং রোগীর মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মানসিক সমস্যার লক্ষণ : মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলো প্রায়ই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে না। অনেক সময় মানুষ নিজেও বুঝতে পারেন না যে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ, অবসাদ, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অতিরিক্ত বিরক্তি বা রাগ, একাকিত্বের অনুভূতি, অনিদ্রা বা অতিরিক্ত ঘুম, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমস্যা এবং আত্মহত্যার চিন্তা এসবই মানসিক সমস্যার লক্ষণ। মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই স্বাভাবিক কাজকর্মে মনোযোগ দিতে পারেন না, যার ফলে তাদের পেশাগত জীবনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়, কারণ তারা প্রায়ই অন্যদের থেকে দূরে সরে যান বা অস্বাভাবিক আচরণ প্রদর্শন করেন। মানসিক সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে তা ব্যক্তির শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। যেমন : উদ্বেগ এবং হতাশা প্রায়ই শারীরিক অসুস্থতার জন্ম দেয়, যা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং বিভিন্ন ধরনের স্নায়ুবিক সমস্যার সৃষ্টি করে।
মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় করণীয় : প্রথমত, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য মানসিক সমস্যাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। শারীরিক অসুস্থতার মতো মানসিক অসুস্থতারও চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এর জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বেশ কিছু উপায় অবলম্বন করা যায়- যেমন :
১, সচেতনতা বৃদ্ধি : মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্কুল, কলেজ এবং কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা এবং কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।
২. পেশাদার সহায়তা : মানসিক সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে পেশাদার সহায়তা নেওয়া উচিত। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। মানসিক সমস্যা ছোট বা বড় যাই হোক না কেন, প্রাথমিক অবস্থায় তা চিকিৎসা করলে দ্রুত সেরে ওঠার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৩. নিয়মিত বিশ্রাম এবং পর্যাপ্ত ঘুম : মানসিক চাপ কমানোর জন্য পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায়ই অনিদ্রা মানসিক সমস্যার একটি প্রধান লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিন নিয়মিত ঘুমানো এবং বিশ্রামের সময় নির্ধারণ করা উচিত।
৪. শারীরিক ব্যায়াম এবং যোগব্যায়াম : শারীরিক ব্যায়াম এবং যোগব্যায়াম মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কে অ্যানডোরফিন উৎপাদন করে, যা আমাদের মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া যোগব্যায়াম এবং ধ্যান মানসিক চাপ কমিয়ে মনকে প্রশান্ত রাখে।
৫. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি : জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ এবং জীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে ইতিবাচকভাবে মোকাবিলা করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
৬. ব্যক্তিগত সম্পর্কের যত্ন : আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব রয়েছে। পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতি ভাগাভাগি করা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং মনের কথা শেয়ার করলে মানসিক চাপ কমে।
৭. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার : আধুনিক জীবনে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারও মানসিক চাপ বাড়াতে পারে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার অতিরিক্ত হলে তা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে সংযম রাখা এবং সঠিক ব্যবহারের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন : মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় নিজেকে ভালোবাসা এবং নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা প্রায়ই অন্যদের যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার কথা ভুলে যাই। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিজেকে সময় দেওয়া, নিজের ইচ্ছা এবং চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। মানসিক সমস্যা কোনো দুর্বলতার লক্ষণ নয় বরং এটি একটি জটিল সমস্যা, যা সময়মতো সমাধান করা প্রয়োজন। মানসিক সমস্যা দেখা দিলে তা গোপন না করে পেশাদার সহায়তা নেওয়া উচিত। নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
শেষ কথা : ‘মন ভালো তো সব ভালো’ কথাটি যেমন সত্য, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্বও অপরিসীম। মানসিক স্বাস্থ্য শুধু একটি সুখী জীবনের মূল চাবিকাঠি নয়, এটি আমাদের পেশাগত দক্ষতা, সম্পর্কের ধরন এবং সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশা কাটিয়ে উঠতে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া শুধু ব্যক্তির জন্য নয় সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। মানসিকভাবে সুস্থ মানুষই একটি সমৃদ্ধ এবং সুখী সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা না করে এর প্রতি সঠিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের প্রতি যত্নশীল হন এবং সময়মতো পেশাদারি সহায়তা নিন।
একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে হলে আমাদের প্রতিটি মানুষকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় উৎসাহিত করা উচিত। কারণ মানসিক সুস্থতা ছাড়া শারীরিক সুস্থতাও অর্থহীন। মনে রাখতে হবে, সবার আগে নিজের মন ভালো রাখতে হবে, কারণ সত্যিকার অর্থেই, ‘মন ভালো তো সব ভালো।’
লেখক : শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ
"