রেজাউল করিম খোকন

  ২৯ অক্টোবর, ২০২৪

মতামত

নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার ঘটাতে হবে

জমি-স্বল্পতা, উচ্চশুল্ক, অপ্রতুল সঞ্চালন ব্যবস্থাসহ নানা কারণে দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোতে খুব একটা অগ্রগতি নেই। গত ১৫ বছরে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে যুক্ত করতে পেরেছে। বিদ্যুৎ পরিকল্পনা পরিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়া বিদ্যুতের মধ্যে সব মিলিয়ে মোট বিদ্যুতের মাত্র ৩ শতাংশ আসে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ থেকে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, দেশের নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন মাত্র ২ শতাংশ, যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে শিগগিরই ৪০টি প্রকল্পের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তিনি বলেছেন, সরকার কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে টেকসই উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বড় পরিসরে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। আমরা সাসটেইনেবিলিটিতে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বৃহত্তর সিস্টেমের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আশা করি, সাসটেইনেবিলিটির লক্ষ্যে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশ এগিয়ে যাবে। উদ্যোক্তা এবং ব্যবসা হিসেবে আমাদের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা কীভাবে পণ্য উৎপাদন করি। সবচেয়ে কম খরচে উৎপাদন করা একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তব ঝুঁকি, যা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে শুধু কমপ্লায়েন্স ইস্যু হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং এটি একটি সঠিক ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা উচিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এখনই নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রসর হওয়া দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বর্তমানে একটি সংকটের সম্মুখীন- ফসিল ফুয়েলের ওপর নির্ভরশীলতা, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং আমদানি করা তেল। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে আরো বেশি অগ্রসর হওয়া দরকার। এ ছাড়া সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং জলবিদ্যুৎ ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। এই পরিবর্তন শুধু পরিবেশকে রক্ষা করবে না, বরং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করবে। আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা হ্রাস করে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের প্রসার ঘটানো দরকার। দু-তিন বছর ধরে বিশ্বে জ্বালানি তেলের বাজারে যে অস্থিরতা চলছে এবং এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তা মোকাবিলা করার অন্যতম উপায় হচ্ছে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা হ্রাস করা। ডলারসংকটের কারণে আমরা একদিকে যেমন বিভিন্ন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করছি, তেমনি জ্বালানি পরিস্থিতির সামাল দিতে লোডশেডিংসহ প্রায় সব জ্বালানির দামের উল্লম্ফন দেখতে পাচ্ছি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো বহুলাংশে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, যদিও বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদনমতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এমতাবস্থায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে আমাদের আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভর করতে হবে, যা বিশ্বের বর্তমান মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আগামী দশকের মধ্যে জ্বালানি তেলের আমদানি প্রায় দ্বিগুণ বাড়বে। এখন উচিত হবে, নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার ঘটানো। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি।

গত এক দশকে সোলার প্যানেল এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির দাম যেভাবে কমে এসেছে, তাতে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের মূল্য ইউনিটপ্রতি ৭ টাকার নিচে নেমে এসেছে, যেখানে বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় খরচ ইউনিটপ্রতি ১০ টাকার ওপরে উন্নীত হয়েছে। সুতরাং সৌরবিদ্যুতের প্রসারের প্রস্তাবগুলোকে যৌক্তিক মনে করার যথেষ্ট উপাত্ত রয়েছে। কিন্তু সৌরবিদ্যুতের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমস্যার প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, সৌরবিদ্যুৎ তৈরি হবে দিনের বেলা যখন সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকে। সন্ধ্যার পর সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন যখন শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে এবং যখন বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ থাকবে, তখন এই চাহিদা মেটানোর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরশীল বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমতার প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বাভাবিকভাবে সারা দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে না, শুধু সন্ধ্যা থেকে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত চালু থাকবে। এদের বলা হয় পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট। মাত্র তিন-চার ঘণ্টা চালানোর কারণে এসব প্ল্যান্টের ওভারহেড খরচ অত্যন্ত অধিক হয় এবং বর্তমান জ্বালানি মূল্যের বাজারে এদের উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ হবে ইউনিটপ্রতি (২২ থেকে ২৫) টাকা, যা আমাদের গড় বিদ্যুৎ খরচের প্রায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে সৌরবিদ্যুৎ যেহেতু সূর্যের আলোর ওপর নির্ভরশীল, তাই মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা প্রভৃতির কারণে এর বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থিতিশীল রাখা সম্ভব নয়। তাই সৌরবিদ্যুতের দ্রুত উত্থান-পতনের কারণে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। সুতরাং সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে আমরা যে আর্থিক সাশ্রয় হওয়ার কথা চিন্তা করছি, তা পেতে হলে সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান চিন্তা করা প্রয়োজন।

নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনার বিচারে বাংলাদেশের স্থান ৪১তম, এর প্রধান কারণ হলো অনভিজ্ঞতা ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সীমিত সম্ভাবনা। তবে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বায়োগ্যাস, বায়োমাস, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাবনাও কম নয়। বিষুবরেখার সন্নিকটে হওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিদিন ৪.০-৬.৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ লাভ করে। অনুমান করা হয় যে ছাদের ওপর, নদী, হাওর, পুকুরের মতো জলাশয়ে, চা-বাগানের অনাবাদি জমি ও ভূমিতে স্থাপিত সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম থেকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ২৪০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সমতা অর্জন করতে পারে। বাংলাদেশের খসড়া জাতীয় সৌরশক্তি রোডম্যাপে ২০৪১ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ৪০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তুতকৃত বাংলাদেশের সৌরসম্পদের ম্যাপ থেকে দেখা যায় যে দেশের দণিাঞ্চলে, উপকূলীয় দ্বীপসমূহ ও পার্বত্য এলাকায় সৌর বিকিরণ অধিক বিধায়, সেসব এলাকা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অধিকতর উপযোগী। আগে ধারণা করা হতো, বাংলাদেশে বায়ুবিদ্যুতের তেমন সম্ভাবনা নেই। সম্প্রতি মার্কিন জাতীয় নবায়নযোগ্য শক্তি পরীক্ষাগার পরিচালিত মূল্যায়ন থেকে বাংলাদেশের বায়ুবিদ্যুৎ সম্ভাবনা অতীতের অনুমিত পরিমাণ থেকে বেশি বলে জানা যায়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ এ জন্য বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশে বায়ুর সর্বোচ্চ গতিবেগ ৭.৭৫ মিলি/সেকেন্ড, যা দিয়ে ৩০ গিগাওয়াট উৎপাদন সম্ভব হতে পারে। সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের মোট জমির ৪ শতাংশ ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব।

এমনিতেই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতির সম্মুখীন দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। ক্রমবর্ধমান হারে জীবাশ্ম জ্বালানি, তেল, গ্যাস, কয়লা পোড়ানোর ফলে এ সংকট আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার মোট দেশজ উৎপাদনের ৭ শতাংশ হারাতে পারে। এনার্জি ট্র্যাকার, এশিয়ার তথ্য অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল-প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার ওপর নির্ভরতা যথাক্রমে ৫৯ ও ১৫ শতাংশ। যৎসামান্য নবায়নযোগ্য শক্তি, সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও ২০১৫-২২ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যতীত বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩ থেকে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে এশিয়ায় এ গড় ২৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে সবুজ জ্বালানি উৎপাদনের হার (২ শতাংশ) দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন এবং তা প্রতিবেশী ভারত (২৩ শতাংশ) ও পাকিস্তান (৪৩ শতাংশ) থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। একের পর এক ভুল নীতি ও সিদ্ধান্ত আমাদের জ্বালানি খাতকে খাদের সামনে নিয়ে গেছে ও আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত করেছে। ফলে জ্বালানি খাতের সংকট সমাধান করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার বিদ্যুৎ-সংকটেরও সমাধান হয়নি।

বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির যে লক্ষ্যমাত্রা তা বাস্তবায়নে চীনা বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য তাদের বিনিয়োগের ঝুঁকি হ্রাসের পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি রোধে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে তহবিল গঠন করতে হবে, যা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্যারান্টি ও নিরাপত্তাবেষ্টনী দেবে। বিনিয়োগকারীদের কর প্রণোদনা ও ভর্তুকি দেওয়াসহ জ্বালানি খাতে চীনের বিনিয়োগ আনতে সরকারি আর্থিক সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারকে তহবিল গঠন ও দক্ষ কর্মী তৈরিতে বিনিয়োগ করতে হবে। বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার নতুন বিদ্যুতের জন্য উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি চীনা বিনিয়োগকারী এবং অর্থায়নকারীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close