আশফাক আহমেদ

  ২৮ অক্টোবর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

পোশাক খাতে স্থিতিশীলতা অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরি

বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির মধ্যে তৈরি পোশাক খাত অন্যতম। জিডিপিতে অবদান ও কর্মসংস্থান তৈরিতে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছে রপ্তানিমুখী এ খাত। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ : কি ইনসাইটস অ্যান্ড ট্রেন্ডস’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, একক দেশ হিসেবে ২০২২-এর মতো ২০২৩ সালেও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চেয়ে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার কম তৈরি পোশাক রপ্তানি করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। আর শীর্ষে বরাবরের মতোই রয়েছে চীন।

ডব্লিউটিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশ ৩ হাজার ৮০০ কোটি (৩৮ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে; বিশ্ববাজারে হিস্যা ছিল ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর আগের বছর রপ্তানির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি (৪৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন এবং এরপর শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশের একটি বড় অংশ বিভিন্ন দেশের বাজারে চলে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

পরিস্থিতি যদিও শান্ত হয়ে এসেছে, তবে ওই সময় দেশের তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার একাধিক কারণ সামনে চলে আসছে। এর মধ্যে ঝুট ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মালিকানার সমস্যা, বকেয়া পাওনা, কিছু ক্ষেত্রে বহিরাগতদের উসকানি এবং শ্রমিকদের নতুন কিছু দাবি-দাওয়া রয়েছে। বিগত এক মাসে তৈরি পোশাক খাতের অস্থিরতাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের প্রভাব খাটানো শুরু করেন। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনই তথ্য উঠে আসে। বিএনপির মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন অভিযোগে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্তদের মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম, যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্নাসহ কিছু নেতার নামে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও বহিষ্কার বা কারণ দর্শানোর নোটিসে পড়েননি।

আগস্টের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তৈরি পোশাক খাতের সংকটের দিকে তাকালে দেখা যায়, রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা, টেক্সটাইল মিল এমনকি সুতা কারখানায় পর্যন্ত তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে চাঁদা বা সুবিধার বিনিময়ে এসব কারখানা আবার চালু করা হয়। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, সাতগ্রাম, গোপালদী, দুপ্তারার ৫৭টি প্রতিষ্ঠানও অনুরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়। বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেই এসব সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অনেককে কেন্দ্রীয় সংগঠন বহিষ্কারও করেছে।

বিএনপি মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে বুঝতে হবে, গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের মানুষের মাঝে এক ধরনের গঠনমূলক মানসিকতা গড়ে উঠেছে। আগামীতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; এ সময় বিগত সরকারের মতো আচরণ বহাল না রেখে বিএনপির উচিত হবে জনগণের মানসিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের সংস্কার করা।

কোনো প্রতিষ্ঠানই তো একক শক্তিতে গড়ে ওঠে না। প্রতিষ্ঠানের সুনামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার কর্মী, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। এর সঙ্গে জড়িত কোটি কোটি টাকার উৎপাদন, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাতের সরবরাহ শৃঙ্খলব্যবস্থা। এভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা বা হামলা হতে থাকলে বিদেশে আমাদের ক্রেতাদের কাছে কী বার্তা যাবে! এই অসন্তোষে লাভ হচ্ছে কার, তা সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার উচিত এ রকম সংকটকে আরো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তা দ্রুত সমাধানের পথ বের করা।

ক্রমাগত পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলা হলেও আসলে তা পুরোপুরি ঠিক হতে সময় লাগবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি রুবানা হক গণমাধ্যমকে জানান, দুই সপ্তাহ কারখানা বন্ধ থেকে ক্ষতি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হচ্ছে, ক্রেতারা সরে যাচ্ছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ২৫-৩০ শতাংশ অর্ডার সরে যাবে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম আক্তার মনে করেন, শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির নেপথ্যে বহিরাগত একটা প্রভাব কাজ করেছে। সব মিলিয়ে সম্ভাবনাময় খাতটি ঠিক কবে পুরোপুরি গতিশীল হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

বহির্বিশ্বে ব্র্যান্ড হিসেবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের নাম যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শ্রমিকের দাবি-দাওয়ার সুযোগে কারখানা বন্ধ থাকছে; উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই ফাঁকে তৈরি পোশাক খাতের অনেক নতুন অর্ডার ভিয়েতনাম, ভারত, মিয়ানমারের মতো দেশগুলোয় চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) পরিসংখ্যান তুলে ধরে এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে মোট ৪৭১ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে দেশটিতে ৭২৯ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে গভীর অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে রয়েছে। অবাধে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে লাগামহীন দুর্নীতি, ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ও একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের অর্থনীতিকে এক রকম খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এ মুহূর্তে যদি তৈরি পোশাক খাতের মতো রপ্তানিমুখী একটি খাতকে নৈরাজ্যের মুখে ঠেলে দিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় অর্থনীতি। কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে দেশের বেকারত্বের বোঝা আরো বাড়বে; বৃদ্ধি পাবে অসন্তোষ। যদিও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে, তবুও সজাগ থাকতে হবে সবাইকে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close