নুরুল্লাহ আলম নুর
মুক্তমত
সংকটের সম্মুখীন তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য
বর্তমান যুগের তরুণ প্রজন্ম তাদের জীবনের এক জটিল সময় পার করছে। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ, সামাজিক পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরিবর্তনশীল পরিবেশে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা দিন দিন বাড়ছে এবং এই সমস্যা তাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। তরুণ প্রজন্মের অবহেলিত এই মানসিক স্বাস্থ্য শুধু ব্যক্তি নয়, পরিবার এবং সমাজের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
অধিকাংশ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী একটি নির্দিষ্ট ধরনের জীবনধারার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে। এতে তারা মনে করে যে অন্যদের জীবন অনেক ভালো ও সফল। এই তুলনার কারণে তারা নিজেদের জীবনকে অনেক সময় কম গুরুত্বপূর্ণ বা অপ্রতুল বলে মনে করতে শুরু করে, যা তরুণ প্রজন্মের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে তাদের প্রাপ্তি ও লক্ষ্যগুলো তুচ্ছ মনে হতে থাকে এবং এ থেকেই তাদের মানসিক চাপ ও হতাশার অনুভূতি তৈরি হয়।
সামাজিক মাধ্যমে সবাই নিজেদের জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো শেয়ার করে থাকে, যা দেখে অনেকেই মনে করে, অন্যদের জীবন তাদের চেয়ে অনেক বেশি সফল এবং সুখী। এই তুলনামূলক ধারণা অন্যদের চেয়ে নিজেকে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে বাধ্য করছে। তারা দেখে যে অন্যরা কী ধরনের জীবনযাপন করছে এবং সেই তুলনায় নিজেদের জীবনকে মূল্যায়ন করতে থাকে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিই তরুণ প্রজন্মের হতাশার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কেউ অতিরিক্ত সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটায় এবং বারবার অন্যের পোস্টগুলোর সঙ্গে নিজের জীবন তুলনা করে, তখন তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয় এবং হতাশা বাড়তে থাকে। কারণ, অন্যের পোস্টে তারা সব সময়ই সুখের মুহূর্তগুলো দেখতে পায়। অথচ নিজের জীবনের প্রতিটি ছোট-বড় সমস্যার সঙ্গে তারা পরিচিত। ফলে তারা মনে করতে থাকে যে তারা পিছিয়ে পড়ছে, তাদের প্রাপ্তি খুবই সামান্য এবং তাদের জীবন অন্যদের মতো আকর্ষণীয় নয়। এর ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে এবং আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য তরুণদের সচেতনভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করা জরুরি এবং তাদের জীবনের ইতিবাচক দিকগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং তুলনামূলক আচরণকে পরিহার করার মাধ্যমে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। নিয়মিত মনের খোরাক এবং সামাজিক সংযোগের মধ্য দিয়ে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেওয়া উচিত, যা তাদের জীবনের সার্বিক উন্নতিতে সহায়ক হতে পারে।
পাশাপাশি শিক্ষা এবং পেশাগত জীবনের চাপেও বর্তমান তরুণ প্রজন্ম নিজেদের ওপর বেশ চাপ অনুভব করছে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য তারা প্রচুর পরিশ্রম করছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক তরুণ তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে অসুবিধায় পড়ছে এবং উদ্বেগে ভুগছে। অভিভাবকদের অপ্রয়োজনীয় চাহিদা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাফল্যের মাত্রা মেপে দেখার প্রবণতা তরুণদের ওপর অপূরণীয় মানসিক চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই চাপ থাকার ফলে তরুণ প্রজন্মের মানসিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং তারা আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপ নিতেও বাধ্য হচ্ছে।
তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার আরেকটি বড় কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক জীবন এবং সহানুভূতির অভাব। প্রায় সময়ই তরুণরা তাদের মানসিক সমস্যার কথা প্রকাশ করতে ভয় পায়, কারণ তারা মনে করে সমাজ তাদের এই সমস্যাকে নেতিবাচকভাবে দেখবে। আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সরাসরি কথা বলাকে এখনো অনেক ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তরুণদের মানসিক সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য উৎসাহিত করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি তরুণরা তাদের সমস্যার কথা সহজে প্রকাশ করতে পারে এবং সমাজ থেকে সমর্থন পায়, তবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটাই উন্নত হতে পারে।
তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসংকট মোকাবিলা করতে সহায়ক হতে পারে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একটি নিরাপদ এবং বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবী, যেখানে তারা তাদের সমস্যাগুলো খোলাখুলি আলোচনা করতে পারবে। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, তরুণ প্রজন্মের সুস্থতাই আমাদের ভবিষ্যতের সুস্থতার প্রতিফলন।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
"