এস এম জসিম
মুক্তমত
সামাজিক শিক্ষায় সমাজ বেঁচে থাকে
শিক্ষা শুধু জাতির মেরুদণ্ড নয়, পরিবার ও সমাজের হাতিয়ার। তবে একাডেমি শিক্ষার পাশাপাশি, সামাজিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। একাডেমি শিক্ষাকে বলা হয় কুড়িয়ে আনা ধন, আর সামাজিক শিক্ষা হচ্ছে রোপণ করা ধান। শিক্ষার সামাজিক দিকটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিক্ষার্থীদের মৌলিক শিক্ষার পাশাপাশি ঐচ্ছিক জ্ঞান অর্জন করা খুবই দরকার। এক কথায় সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ হতে হবে। এই শিক্ষা সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং মানবিক চেতনা জাগ্রত করে। যার অন্যতম একটি লক্ষ্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ব করা। শিক্ষিত মানে পাঠ্যগত জ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট নয়, সুশীলসমাজের একজন বুদ্ধিজীবী হতে হবে।
আমরা হয়তো জানি না, ‘সমাজের নীতির মধ্যেই সভ্যতা বেঁচে থাকে’। অর্থাৎ সমাজ যেদিকে হাঁটবে, সভ্যতাও সেদিকে পা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য। যদি সমাজকে একজন দায়িত্বহীন ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়, অচিরেই সমাজ ও সভ্যতার মৃত্যু হবে। ফলে জন্ম নেবে একটি বেখেয়াল সমাজের। আসল রহস্য হচ্ছে ধীরে ধীরে আমরা আধুনিক হচ্ছি, শিক্ষিত হচ্ছি কিন্তু প্রকৃত একজন সামাজিক মানুষ হওয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। যদিও শিক্ষাকে সমাজ ও পরিবারের হাতিয়ার বলা হয়, তবে শিক্ষাটা হওয়া দরকার সামাজিক শিক্ষা। মৌলিক শিক্ষা শুধু জীবিকা ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখে কিন্তু সামাজিক শিক্ষা মূল্যবোধ তৈরি করে, তা প্রকারান্তরে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হতে সহায়তা করবে। এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা বর্তমানে ফলকেন্দ্রিক শিক্ষার ওপর বেশি জোর দিচ্ছি, যেখানে একজন শিক্ষার্থী মৌলিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত দক্ষতা অর্জনে পৃষ্ঠপোষণা নয়। কিন্তু পাঠ্যক্রমের বাইরে যে আরো কিছু শিক্ষা আছে, সেদিকে আমরা সম্পূর্ণটাই বেখায়াল।
এ জন্য সবাইকে সামাজিক শিক্ষায় উৎসাহিত করা উচিত। কেননা শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ড যদি মজবুত না হয়, তবে অল্প আঘাতেই জাতি নুইয়ে যাবে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত করতে হবে। এই শিক্ষার্থীদের হাতেই নির্মাণ হবে আগামীর সভ্য সমাজ।
আজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ পাঠ্যক্রমের চাপ, ত্রুটিপূর্ণ পাঠ্যক্রম কিংবা অন্য কারণে সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে জড়াচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সমাজে কিশোর অপরাধ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবার ও সমাজ।
সাম্প্রতিক বখাটে ছেলেদের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের উত্ত্যক্তে নারী শিক্ষার হার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নারী-পুরুষের সমান অবদান দরকার। নারী শিক্ষা যদি পিছিয়ে যায়, পরবর্তী প্রজন্ম ভুক্তভোগী হবে। একজন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষক হচ্ছে মা। এই মা যদি অল্প বিদ্যায় সীমাবদ্ধ থেকে যায়, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সামাজিক শিক্ষার অভাবে শুধু যে শিশু, নারী ক্ষতিগ্রস্ত তা নয়, কিশোরও আদর্শ জীবন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা শিক্ষার আলো থেকে বেরিয়ে, অন্ধকার নেশার জগতে ভিড় জমাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে অদক্ষ বেকার।
মোটাদাগে আমরা কেউই এ থেকে রেহাই পাচ্ছি না। কাজেই আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন কতগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা বাধ্যতামূলক কিন্তু ফলাফলে কোনো প্রভাব পড়বে না। একজন শিক্ষার্থী তার মৌলিক লেখাপড়া দিয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে এটা ঠিক। পাশাপাশি একজন ভালো, মানবিক ও সচেতন মানুষ হতে হলে যা যা করা ও শেখা দরকার, তা যেন সে শিখতে ও করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে আমাদের যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। অল্প বয়স থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই চেতনা জাগ্রত করতে পারলে আগামী পৃথিবী শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও কিশোরদের জন্য আনন্দময় ও আরামদায়ক হবে। আমাদের শিক্ষাকে সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ
"