ইলিয়াজ হোসেন রানা
দৃষ্টিপাত
যুদ্ধ, যুদ্ধবন্দি ও ইসলাম
আজকাল যুদ্ধের ভয়াবহ ও মর্মান্তিক পরিণাম দুনিয়ার মানুষের কাছে এতই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, স্বয়ং সেনানায়করাও এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাপার বলে মনে করেন। জেনারেল চার্লস নেপিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহরূপ অত্যন্ত চমৎকার উপমার সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, একজন যোদ্ধার জীবন সেই বাইজির মতো, যাকে এমনই একটা হলে নাচতে দেওয়া হলো, যার দেয়ালগুলোয় ভাঙা কাচ গেঁথে রাখা হয়েছে। যখনই সে নাচতে নাচতে দেয়াল ঘেঁষতে যায়, অমনি তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তের স্রোত বয়ে চলে। সঙ্গে সঙ্গে তার নাচের উন্মাদনা ও তন্ময়তা ছুটে যায়। সে বেচারা চোখ খুলে দেখতে পায় যে তাকে বিরাট এক ষড়যন্ত্র জালে আবদ্ধ করা হয়েছে। ঠিক তেমনি একজন যোদ্ধা সমরাস্ত্রের চাকচিক্যে আকৃষ্ট হয়ে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যায় বেশ হাসিখুশি ভাব নিয়েই। কিন্তু কয়েক দিনেই তার চোখ খুলে যায় এবং দেখতে পায় যে অস্ত্রের চাকচিক্য কতখানি অন্ধ করেছিল।
তাই সে তার পথ অন্ধকার দেখতে পায় এবং তার মনে হয় রক্ত ও কাঁটার বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝখানে এনে তাকে রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মানুষের চারিত্রিক মান দিন দিন উন্নত হয়ে চলেছে। বর্বর যুগের নির্দয়তা ও অত্যাচারমূলক রীতিনীতি প্রায়ই লোপ পেয়ে চলেছে। তার বদলে সহানুভূতি ও ত্যাগের স্পৃহা ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে। অতিতে যুদ্ধ ছিল একটা প্রশংসনীয় ব্যাপার। কিন্তু আজ তাকে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ বলে গণ্য করা হয়। কিছুদিন আগে মানুষ ভেড়ার ভেতরে লড়াই বাধিয়ে গৌরববোধ করেছে। আজকের প্রত্যেকটি সভ্য মানুষ তা করতে লজ্জাবোধ করে। আগেরকার দিনে পশুর লড়াই দেখার জন্য বিশেষ ময়দান নির্বাচিত করা হতো। এভাবে পশুগুলো কি ভীষণ বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে মানুষ মহা-আনন্দ উপভোগ করত। আজ পশু রক্ষার সমিতি গড়ে তোলা হচ্ছে এবং পশুগুলোকে অকথ্য জুলুমের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে সমিতি করে নেওয়া হয়েছে। এভাবে পশুও আজ মানুষের দয়া ও সহানুভূতি লাভ করে চলছে।
যুদ্ধের ভিত্তিমূল হলো হিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা। পৃথিবীর এমন কোনো জাতি নেই, যাদের বুকে এ অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বালিত হয়নি। তাই আন্তর্জাতিক সন্ধি ব্যাহত অসম্ভব মনে হয় কিন্তু যুগের ভিত্তিতে আরেক যুগ সম্পর্কে ধারণা ভুল। প্রাচীন যুগে সব জাতি ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছার আত্মহুতি দিত এবং সে ব্যক্তিও জাতির সব স্বার্থ স্বীয় স্বার্থের বেদিতে উৎসর্গ করত। পক্ষান্তরে, আজ প্রায় সব দেশের সব জাতি মুক্ত ও স্বাধীন। তাদের বাদশাহ তারাই গড়ে ও চালায়। পৃথিবী এখন ব্যক্তিবিশেষের অত্যাচার-উৎপীড়নের হাত থেকে নিস্তার লাভ করেছে। তারা এখন তাদের সর্ববিধ কল্যাণ ও স্বার্থকে প্রিয়তরভাবে। বিভিন্ন জাতির ভেতরে এই একই ধরনের লক্ষ্য ও আদর্শ পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতির দারমুক্ত করেছে। স্বেচ্ছাতন্ত্রের জঘন্য পর্দা এখন আর এক জাতিকে অপর জাতি থেকে আড়াল করে রাখে না।
ইংরেজ ও ফরাসি জাতির ভেতরে যে বিদ্বেষ ও বিরোধ চলছিল তার চেয়ে বড় উদাহরণ জাতিতে জাতিতে বিরোধ বিসম্বাদের ইতিহাসে আর মিলবে কি? কিন্তু কল্যাণ চিন্তা ও সন্ধি ব্যবস্থা উভয় জাতিকে আজ একাকার করে দিয়েছে। আজ ইংরেজি ও ফরাসি সৈন্যরা একই কাতারে দাঁড়িয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছে। জার্মান ও ফরাসি যদিও দুটি পরস্পরবিরোধী জাতি এবং একদল অন্য দলের রক্তপানের জন্য উদগ্রীব, তথাপিকালে যে তাদের ভেতরেও কল্যাণকর সন্ধি ব্যবস্থা জয়ী হবে, সাময়িক ঘটনা প্রবাহে সে কথা আমাদের অস্বীকার করলে চলবে না। এটা অসম্ভব নয় যে এক দিন জার্মানি ইংল্যান্ড একাকার হয়ে যাবে।
আগেরকার জাতিরা যুদ্ধবন্দিদের এরূপ অপরাধী ভাবত, কোনো আইনই তাদের বিন্দুমাত্র সহায়তা করতে সমার্থ হতো না। তাই তাদের অত্যন্ত নির্দয়ভাবে হত্যা করা হতো। বলাবাহুল্য, যুদ্ধবন্দিদের বেলায় আশুরি, মিসরি ও ইহুদি জাতির নীতি ছিল ভয়ানক। এমনকি, তাদের জবরদস্তির হাত অনেক সময় বন্দিদের আওতা পেরিয়ে স্বাধীন মানুষের গর্দান পর্যন্ত পৌঁছে যেত। ফেরাউন বনু ইসরায়েলের নিষ্পাপ শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এর কয়েক যুগ পর তাদের এই চরম নীতির কিছুটা শিথিল হলো; ব্যাপক বিপ্লবের মাধ্যমে। হত্যার বদলে দাস বানানোর নীতি গ্রহণ করল। এটা অবশ্যই জয়ী ও বিজিতদের হত্যাকার্য অনুষ্ঠান থেকে কিছুটা ভালো ব্যবস্থা। রোমোকরাই সর্বপ্রথম এ নীতি অনুসরণ করল। প্রথম প্রথম অবস্থা এই ছিল, যে সিপাহি যাকে বন্দি করত সেই তার মালিক। কিন্তু কিছুদিন পরই রোমসম্রাট সেই মালিকানা নিজের করে নিলেন।
তবে মধ্যযুগে রোমকরা আবার সেই প্রাচীন হত্যানীতি অনুসরণ শুরু করল। যুদ্ধবন্দিদের দাসে পরিণত করার বদলে তরবারির শিকারে পরিণত করল। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের ক্রয়-বিক্রয় ও দাসে পরিণত করার অধিকারও তাদের রয়ে গেল। এরপর স্বার্থপরতার আরো একধাপ এগুলো। মানে যুদ্ধবন্দিদের বিনিময়ে মোটা অর্থসম্পদ আয়ের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। অবশেষে শেষ যুগে ইয়াফায় নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ২০০০ কয়েদিকে হত্যা করে আবার সেই বর্বর দৃশ্য পৃথিবীর সামনে উদ্ভাসিত করে তুলল। অবশ্য দুনিয়ার মানুষের কাছে নেপোলিয়ন কৈফিয়ত দিল, ‘এরা আরো একবার বন্দি হয়ে আমার হাতে মুক্তি লাভ করে পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় এই শাস্তি দেওয়া হলো’। বর্তমানে আবু গারিব কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে আমেরিকার সৈন্যরা যে অমানবিক নির্যাতন জুলুম করছে, তা কোনো সভ্যজগতের কাজ হতে পারে না।
বদর যুদ্ধে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৭০ জন কয়েদির মধ্যে সামর্থ্যবানদের থেকে বিনিময় গ্রহণ-পূর্বক মুক্তির ব্যবস্থা করেন। যাদের সামর্থ্য ছিল না তারা ১০ জন করে মুসলমান শিশুকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। বনু মুস্তালিকের যুদ্ধবন্দিদের একদল কয়েদির থেকে বিনিময় গ্রহণ করেন। অন্যদল থেকে বিনিময় ছাড়াই আজাদি করে দিলেন। দুমাতুল জন্দলের যুদ্ধে প্রায় ১০০ স্ত্রী ও শিশুবন্দি হয়েছিল। আবু জায়েদ মুসলমান হয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে মুক্তির জন্য আবেদন জানালে তখনই হজরত জায়েদ বিন হারিসকে নির্দেশ দিলেন মুক্তির জন্য। বনু তামিমের যুদ্ধে সাহাবারা ১১ জন নারী ও ৩০টি শিশু বন্দি করেছিলেন। হজরত সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তাদের রিমালা বিনতে হারিসের দায়িত্বে আবদ্ধ রাখলেন। যখন তাদের দলপতি এলেন, তখন তারা তাকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করল। ফলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) সবাইকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। হাওয়াজিনের যুদ্ধে ২০০০ নর-নারী বন্দি হয়ে এলেন। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তখন সাহাবাদের ডেকে বললেন, এখনই সব বন্দিকে ছেড়ে দেন। যারা বিনিময় লাভের আশা রাখেন, তারা কিছুদিন ধৈর্য ধরুন। আমার পঞ্চমাংশ গনিমতের মাল হাতে এলেই প্রত্যেক কয়েদির বিনিময়ে আমি ১৬টি উট দেব।
ইয়ামামার যুদ্ধে শিমামা নামক এক সর্দার বন্দি হয়ে এলে রাসুল (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কাছে কিছু আছে কি? সে জবাব দিল, যদি আপনি আমাকে হত্যা করতে চান, তাহলে আমার শিরায় রক্ত আছে, যদি আমাকে ক্ষমা করতে চান, তাহলে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জিহ্বা রয়েছে, যদি ধন-সম্পদ চান, তাহলে যত চান তা সহজেই দেওয়া যাবে। রাসুল (সা.) তার উত্তর শুনে পরদিন তাকে বিনা খিসারাতে মুক্তি দিলেন। মুক্ত হয়ে কালেমা পড়ে শিমামা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। বনু কুরাইজার যুদ্ধে অনেক যুদ্ধবন্দিদের হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব সহজেই মুক্ত করে দিয়েছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম মদিনার বনু নাজির ইহুদি সম্প্রদায়কে মদিনা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তখন তাদের ভেতরে নব দীক্ষিত কিছু ইহুদি শিশু ছিল। সাহাবারা তাদের ধর্ম থেকে ফেরানোর জন্য রেখে দিতে চাইলেন। তখন সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ২৫৪ নম্বর আয়াত নাজিল হলো : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বললেন, ধর্মে জবরদস্তি কোনো স্থান নেই। এ কথা নিশ্চিত যে, সত্য ও অসত্যের পার্থক্য স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
আধুনিক যুগে উদারনীতিভিত্তিক আইন-কাননের দৃষ্টিতে বন্দিদের পোশাক-আশাক ও সাজসজ্জা খুলে নেওয়া চলে না। কিন্তু ইসলামের মহান বিধানে শুধু তাই নয়, বন্দিদের উপযুক্ত পোশাকপরিচ্ছদ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বদরের যুদ্ধে যখন হজরত আব্বাস বন্দি হয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে প্রায় নগ্ন অবস্থায় নীত হলেন, তখন তিনি আবদুল্লাহ বিন সলুলের জামা নিয়ে তাকে দিলেন। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর কোনো জাতি যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে উদারতা দেখাতে পারেনি। বন্দিদের দৈহিক কষ্টের চেয়েও বেশি মর্মান্তিক হলো মানসিক যাতনা। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকায় যে বিরহ বেদনার সৃষ্টি হয়, তার তুলনা হয় না। ইসলামই বন্দিদের দৈহিক কষ্ট দূর করার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক কষ্ট দূর করারও ব্যবস্থা রেখেছে। যেকোনো সময়ে আত্মীয়স্বজন এসে বন্দিদের সঙ্গে দেখাশোনা করে যেত অবাধে। হজরত আলি (রা.) যখন জনৈক দাসীকে মা থেকে দূরে রাখতে চাইলেন, তখন হজরত
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালাম তাকে বাধা দিলেন। এ নীতির ভিত্তিতেই ইসলাম কখনো বন্দিদের ধর্ম-মত নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করত না।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক
"