এম আবদুল্লাহ আল মামুন খান
মতামত
সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে রদবদলে নির্ভরযোগ্যরাই নেতৃত্বে
দীর্ঘ বর্ণাঢ্য সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ারের দিগন্তরেখায় ঊষার উন্মেষে আলোকিত করেছেন নিজেদের। দক্ষতা, নীতি, সর্বোচ্চ পেশাদারি, আনুগত্য আর সততার সঙ্গে আধুনিক-অগ্রসর চিন্তার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। ইস্পাতকঠিন মনোবলের সঙ্গে পরিণত ভাবনার মননশীলতার মূল্যবোধকে করেছেন উচ্চকিত। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আরো সামনে এগিয়ে নেওয়ার দুর্বার প্রতীতিতে আশাবাদের স্বর্ণালোকে তারা প্রত্যেকে সূত্রপাত করেছেন চ্যালেঞ্জিং নতুন অধ্যায়ের। হৃদয়ের বিভায় নিজ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে নিজেদের মিশিয়েছেন কর্মের চাঞ্চল্যে; সাহসিক প্রেরণাশক্তিতে ও গভীর দেশপ্রেমের নির্যাসে। স্বভাবতই শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পূর্ণ আস্থা রেখেছেন তাদের ওপর।
দক্ষ নেতৃত্ব গুণাবলিতে নির্ভরযোগ্য হিসেবেই সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদমর্যাদার দুই কমর্কতা মো. ফয়জুর রহমান ও মো. মাইনুর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে করা হয়েছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল। তাদের যথাক্রমে সেনা সদরের কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেলের (কিউএমজি) ও আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) জিওসি করা হয়েছে। শূন্য হওয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক (ডিজি) পদে নিয়োগ পেয়েছেন ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কুমিল্লার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। সামরিক জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যোগ্য নেতৃত্ব প্রদানে সফলতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়েই তারা পেয়েছেন গুরুদায়িত্ব। ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণ-অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্বভার গ্রহণের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে এটি তৃতীয় দফা বড় রদবদল। সোমবার (১৪ অক্টোবর) বিভিন্ন সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করে।
নতুন দুই লেফটেন্যান্ট জেনারেল, ডিজিএফআই পেল নতুন ডিজি : নতুন তিন তারকা জেনারেল মো. ফয়জুর রহমান প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক ও মো. মাইনুর রহমান ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ১২ আগস্ট মেজর জেনারেল মো. ফয়জুর রহমানকে ডিজিএফআই মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। তিনি ২৩তম বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। মিরপুরে ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের (ডিএসসিএসসি) ২৮তম কমান্ড্যান্ট হিসেবে এবং তার আগে ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও রংপুরের এরিয়া কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একসময় ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা নিরাপত্তা ইউনিটের কমান্ড্যান্ট। ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি থাকাকালে তিনি নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপে ‘জয়েন্ট ম্যানুভার এক্সারসাইজ-২০২২’ নামে মহড়ার আয়োজন ও পরিচালনা করেন।
আর্টডকের জিওসি পিরোজপুরের সন্তান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমান ২৪তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে কমিশনপ্রাপ্ত হন। সব বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য কোর্সের সেরা চৌকস ক্যাডেট বিবেচিত হয়ে অসামান্য গৌরবমণ্ডিত সোর্ড অব অনার লাভ করেন। তিনি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হিসেবে দায়িত্বের আগে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও কুমিল্লার এরিয়া কমান্ডার ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিক থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ডিজিএফআইয়ের নতুন মহাপরিচালক হয়েছেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, যিনি কুমিল্লায় ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। নতুন দায়িত্বে তিনি হবেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. ফয়জুর রহমানের উত্তরসূরি। ঢাকা সেনানিবাসের কচুক্ষেতে ডিজিএফআইয়ের ১৪-তলা ভবনে তিনি বসবেন। মেধাবী সেনা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম ২৬তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে কমিশন লাভ করেন। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কুমিল্লা এরিয়ায় পুলিশের মনোবল ফেরাতে এবং বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার কার্যক্রমসহ নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে দক্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সামরিক বাহিনীর অত্যন্ত প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ এই পদটিতে সাধারণত সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়। এবার এই পদটিতে বেছে নেওয়া হয়েছে মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আলমকে।
অবারিত আনন্দের ফল্গুধারার আবাহনে অযুত সম্ভাবনাময় নতুন অধ্যায়ের প্রারম্ভে অনলাইন-অফলাইনের বিশাল ক্যানভাসে নিজ জেলার বাসিন্দাদের প্রীতি ও শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন এসব চৌকস সেনা কর্মকর্তারা। অভিজ্ঞতা ও অর্জনের স্বর্ণালি সংযোগসূত্রে দেশের মানুষের ভালোবাসা আর আত্মপ্রত্যয়ের মিলিত শক্তিতে তারা নিজেদের উজ্জ্বল নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় নিজ নিজ নতুন দায়িত্বেও সততা, পেশাদারি, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সর্বোচ্চ প্রমাণ রাখতে সক্ষম হবেন। দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করবেন বলেই মনে করছেন কাছের থেকে দূরের সবাই।
আগের দু-দফা রদবদলের সারসংক্ষেপ : ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে প্রথম দফা রদবদলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পর্যায়ের ৫ কর্মকর্তার দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হয়; চাকরি হারান টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। সেনাবাহিনী থেকে তাকে সেদিন অব্যাহতি দেওয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন মেজর জেনারেল আ স ম রিদওয়ানুর রহমান। একই দিনে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীমকে সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফের (সিজিএস) দায়িত্বে আনা হয়। তৎকালীন সিজিএস লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ শাহীনুল হককে কমান্ড্যান্ট করে পাঠানো হয় ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে (এনডিসি)।
আর এনডিসির কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনরত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলমের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। সেনা সদরের কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মজিবুর রহমানকে আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) জিওসি করা হয়। আর্টডকের ওই সময়কার জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহম্মদ তাবরেজ শামস চৌধুরীকে করা হয় কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি)। গত ১২ আগস্ট মেজর জেনারেল মো. নাসিম পারভেজকে এমআইএসটি কমান্ড্যান্ট ও মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদকে আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে গত মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পৃথক পৃথক প্রজ্ঞাপনে আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মজিবুর রহমানকে বরখাস্ত, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহম্মদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল হামিদুল হককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এরপর থেকে দুটি লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পদ শূন্য ছিল। এই দুই পদে মেজর জেনারেল পদ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে স্থলাভিষিক্ত হন মো. ফয়জুর রহমান ও মো. মাইনুর রহমান। এর আগে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের বিদায়ি প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীমের স্থলাভিষিক্ত হন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে তাকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান লেফটেন্যান্ট জেনারেল র্যাংক ব্যাজ পরিয়ে দেন।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক সন্ধানী বার্তা
"