নাজনীন বেগম
দৃষ্টিপাত
পরিবেশদূষণ প্রতিরোধে চাই জনসচেতনতা
শস্য-শ্যামল স্নিগ্ধ আবহমান বাংলাদেশ। সবুজের সমারোহে চিরন্তন বাংলার যে রূপ মাধুর্য তাও শাশ্বত বঙ্গভূমির অনন্য শোভা। সমুদ্র, নদী, পাহাড় আর বন-বনান্তরের অভাবনীয় মিলন সৌধে নৈসর্গিক বাংলা তার পরিবেশ পরিস্থিতিকে অবারিত করতে হরেক বাধাবিঘ্নকেও যেন সামলাতে হচ্ছে। সংগত কারণে নানামাত্রিক দূষণ প্রক্রিয়াও শ্যামল বাংলার ওপর আঘাত করতে থামছে না। বিভিন্ন সময় দূষণ প্রক্রিয়ার কার্যক্রমের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞাও চলমান থাকে।
বিশেষ করে হর্ন বাজানো ও পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার অনাকাঙ্ক্ষিত দূষণকে যেন উসকে দিচ্ছে। দেশের পরিবেশ, বন আর জলবায়ুর ওপর নেতিবাচক প্রক্রিয়ায় বর্তমান সরকারও সোচ্চার। নিয়ম বিধি আরোপ করাও সুস্থ পরিবেশের জন্য জরুরি। সারা দেশ প্রচণ্ডভাবে শব্দদূষণে বিব্রত, আক্রান্তও বটে। আর পলিথিনের ব্যবহারের পর যত্রতত্র তা ফেলে দেওয়ায় প্রকৃতির ওপর যে বিরূপ প্রভাব দেখা দেয় তাও বিপন্নতা।
হর্ন বাজানো দেশের দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এক অপরিণামদর্শিতার নগ্ন রূপ। ভারী যানবাহন তো বটেই, ব্যক্তিগত গাড়ির চালকরাও এই বদঅভ্যাস থেকে মুক্ত নয়। শুধু কি হর্ন বাজানো, মাইকিং, বিজ্ঞাপন ছাড়াও বিভিন্ন কারণে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্নতায় এগিয়ে নিচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর কঠোর নজরদারিতে প্রাসঙ্গিক নিষেধাজ্ঞাকে আমলে নিয়েছে।
সেখানে নির্দেশ এসেছে ১ অক্টোবর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারপাশের তিন কিলোমিটার জুড়ে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করে শব্দদূষণকে কমিয়ে আনার। কিছু সংকেত চিহ্ন অনুসরণ করাকে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। লাল-সবুজ বাতি থেকেই চালক বুঝে নেবে তার যানবাহনের গতি প্রকৃতি। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন বিধিই চালু রয়েছে। হর্ন শুধু যে শব্দদূষণ বাড়ায় তা কিন্তু নয় বরং শ্রবণশক্তির ওপরও প্রচণ্ড আঘাত হানছে। তাই চালকই নির্ধারণ করবে হর্ন বাজানো আসলেই জরুরি কি না।
এই মাসের প্রথম থেকেই হর্ন নিয়ন্ত্রণ করার আইন চালু করা হয়। তার যদি সামান্য গাফিলতি কিংবা অমান্য দেখা যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট চালককে শাস্তি দেওয়ার কথা বিবেচনায় এনেছে সরকার। জরিমানা করা হবে প্রথমবার ৫০০ টাকা। পরে যদি আবার আইন ভঙ্গ হয় টাকার পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে। যেকোনো দেশে নিয়মশৃঙ্খলার জন্য আইনানুগ বিধি ব্যবস্থা প্রাসঙ্গিক এবং জরুরি। তবে উদ্ভূত হরেক সমস্যা, যা প্রত্যেক মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, সেখানে সবচেয়ে জরুরি ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং উদ্যোগ। সব সময় সবকিছু আইন-আদালত দিয়ে হয় না।
সে ক্ষেত্রে প্রত্যেকের নীতি, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, যৌক্তিকতা, নিজের ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকা জরুরি এবং আবশ্যক। তাই পরিবেশ সুরক্ষার দায়বদ্ধতা সব মানুষের। বিপন্ন এবং অসুস্থ পরিবেশে প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তানরা নিজেরাও ভালো থাকার কথা নয়। আগামী প্রজন্মও মাতৃগর্ভ থেকেই দূষণের শিকার হচ্ছে বলে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে উঠে আসছে। মায়ের জঠর থেকেই যে শিশু দূষণকে মোকাবিলা করছে, তার পৃথিবীর আলো দেখার পরও কোনো আলোকিত ভুবন না পাওয়ার দুঃসহ যন্ত্রণা কোনোভাবেই স্বস্তিকর নয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হর্ন নিয়ন্ত্রণকে বিবেচনায় আনতে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট চালকসহ সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। হর্ন বাজানো দীর্ঘদিনের অভ্যাস হলেও সেখানে পরিবর্তন আনা জরুরি। তাই সবাইকে বুঝতে হবে তার ভালো-মন্দের হিসাব। শব্দ হোক কিংবা বায়ুদূষণই হোক পরিবেশ সুরক্ষিত না থাকলে সন্তানদেরই ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা।
ধরণীকে বাসযোগ্য করতে গত শতকের শেষ দশক থেকেই নিসর্গ বিজ্ঞানীরা আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন। প্রকৃতিকে তার সহজাত বৈশিষ্ট্যে পুনরুজ্জীবিত করা নিতান্ত জরুরি। সংগত কারণে বিষময় সমস্ত উপাদান, কার্যক্রম পরিহার করতে পিছু হটলে কোলের সন্তানদেরই ক্ষতির আশঙ্কায় পড়তে হবে। দুনিয়াকে বিপন্নতা থেকে সুরক্ষা দিতে পরিবেশবিজ্ঞানীদের কপ সম্মেলনও এক অবধারিত কর্মযোগের নিরন্তর যাত্রা। আগামী সম্মেলনে আবারও জোরেশোরে আওয়াজ উঠবে দূষণে আক্রান্ত বিশ্বকে নতুন অবয়বে সুরক্ষার কবচে আগলে রাখার দৃঢ়প্রত্যয়।
পরিবেশদূষণে পলিথিনের অপব্যবহার ও প্লাস্টিকের উপস্থিতি যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। তাই পলিথিনের ব্যবহার পরিহার করতে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে। বর্তমান সরকার এমন অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নিষিদ্ধ করা এই ক্ষতিকর জিনিসের ব্যবহার কমিয়ে আনার ওপর প্রাথমিকভাবে সুপারিশ আসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে। ধাপে ধাপে তা ব্যবহারের অনুপযোগী করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সংগত কারণে সতর্কতা আসে সবার আগে বিভিন্ন সুপারশপে। বিকল্প হিসেবে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে দেশের বাজারে তার চিত্র উল্টো।
চাহিদা অনুযায়ী পাট ও কাপড়ের ব্যাগ এতই অপ্রতুল, যা গ্রাহকদের জন্য স্বস্তিকর নয়। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্যই চরম ঘাটতি। তবে শপিং মলে বেচা-বিক্রির কমতি নেই। সংগত কারণে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সুতা কিংবা চিকন দড়ি দিয়ে তৈরি জালি ব্যাগই এখন সম্বল। তবে পাটের ব্যাগ একেবারে নেই বলা যাবে না, যা আছে তার এত দাম নির্ধারণ করা হয় বিকিকিনির জন্য এক প্রকার অধরাই থেকে যাচ্ছে। পাট কিংবা কাপড়ের ব্যাগের উৎপাদন বাড়াতে হবে বলে বিজ্ঞজনদের পরামর্শ আসছে। সেটাও সময়সাপেক্ষ বিষয়। সব মিলিয়ে বিভিন্ন সুপারশপে ক্রেতাসাধারণ রয়েছেন বিপাকে।
নানা মন্তব্যও উঠে আসছে। পলিথিন কিংবা প্লাস্টিক নিষিদ্ধের আগে কেন বিকল্প কোনো ব্যবস্থা তৈরি করা গেল না? সমস্যাটা তো আজকের নয়। তবে শুভ সংবাদও আছে। নতুন করে পাটজাত ব্যাগ তৈরি করতে হবে। যার কারণে পাটের ব্যাগ অভ্যন্তরীণ বাজার পাবে। ফলে পাটের প্রান্তিক কৃষকরাও লাভবান হবেন। পাট বাংলাদেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এক অনন্য কৃষিজাত অর্থকরী ফসল, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও অনেকখানি এগিয়ে। তাই পাটের অভ্যন্তরীণ বাজারও জরুরি এবং দেশের জন্য মঙ্গলকর বটে। তবে এখানে ক্রেতা-বিক্রেতার আপত্তিও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন শপিং মলে পণ্যের দাম অনেকটাই বেশি। সেখানে আবার পাটের ব্যাগ ব্যবহার প্রচলনে ক্রেতা-বিক্রেতার উভয়েই দামের বিষয়টা হিসাবে এসে যাচ্ছে। তবে সবার আগে পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনাও অন্যতম কার্যক্রম। পাট আমাদের ঐতিহ্যিক সম্পদ, যা একসময় সোনালি আঁশ হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত ছিল। শুধু বিদেশে রপ্তানি করতে হয় বলে পাট চাষও বিভিন্নভাবে কমে আসছে। অনেক কৃষক জানেনই না পাট চাষের সামগ্রিক কর্মযোগ। নতুন করে তা আবার জেগে ওঠাও পাটজাত দ্রব্যের জন্য আশার আলো নিয়ে আসবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাঙা করতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : সাংবাদিক
"