মরিয়ম খানম সেতু

  ১৭ অক্টোবর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা নাকি সম্ভাবনা

জনসংখ্যা বলতে কোনো নির্দিষ্ট এলাকা, শহর বা দেশে বসবাসরত জনগণকে বোঝায়। আর যখন কোনো দেশের জনসংখ্যা, প্রাপ্ত সম্পদের তুলনায় কম বা বেশি হয় এবং জাতীয় কল্যাণ ও অগ্রগতি ব্যাহত করে, তখন তা সমস্যায় পরিণত হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যা সমস্যা বা সম্পদ উভয়ই হতে পারে। যদি কোনো দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা খুব কম হয়, এমনকি সে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যে পরিমাণ জনসংখ্যা প্রয়োজন, তার চেয়ে কম জনসংখ্যা থাকে, তবে সে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোনো সমস্যা নয়।

যে দেশে আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি এবং জনগণ উৎপাদনমুখী কাজে অদক্ষ হয় সে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি মারাত্মক সমস্যা। কোনো দেশে এরূপ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বহুবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেমন : জীবনের মৌল চাহিদার (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা) ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। গ্রাম ও নগর ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বনজঙ্গল ও গাছপালা কেটে বসত নির্মাণ ও কৃষিজমি বাড়াতে গিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ কমে যায়। কর্মসংস্থানের অভাবের ফলে বেকারত্ব সৃষ্টি হয় ইত্যাদি। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব সর্বস্তরে ছড়িয়ে আছে, পথঘাট থেকে শুরু করে হাসপাতাল অবদি সর্বত্র মানুষের ভিড়।

টমাস রবার্ট ম্যালথাস ১৭৯৮ সালে তার জনসংখ্যা তত্ত্বে বলেন, ‘দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার অপেক্ষা অধিক হয়, তবে তাকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশ বলা হবে।’ এ ক্ষেত্রে দেশে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, খাদ্যাভাব ইত্যাদি নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। তার মতে, জনসংখ্যা

সমস্যাটিকে দেশের সামগ্রিক সম্পদ ও উৎপাদন ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা উচিত। তার মতে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দেশে যে জনসংখ্যা থাকলে মাথাপিছু আয়

সর্বোচ্চ হয়, তখন তাকে কাম্য জনসংখ্যা বলে। কোনো দেশে প্রকৃত জনসংখ্যা সম্পদ অপেক্ষা বেশি হলে তাকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার দেশ বলে।

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৭ কোটির অধিক। স্বল্পায়তনের (১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিমি) এ দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ১১১৯ প্রতি বর্গ কিমি (২০২২ আদমশুমারি তথ্যানুযায়ী) বাংলাদেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ জীবনমান বৃদ্ধির প্রধান বাধা।

এ দেশে মানুষ অধিক সন্তানকে আয়ের পথ ও বার্ধক্যের নির্ভরশীলতা মনে করে। যে কারণে তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ অপছন্দ করে। তারা অধিক সন্তান জন্ম দেয়, তবে তারা শিক্ষা নিয়ে একদম অসচেতন। উপার্জনের আশায় অল্পবয়সে সন্তানকে কাজে পাঠায় এতে করে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুশ্রমিকরা সামান্য অর্থের আশায় নানা অপরাধকর্মে লিপ্ত হচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। জনসংখ্যার বিরাট অংশ কাজে অদক্ষ ফলে তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারছে না।

বেকারত্বের হতাশায় তারা জুয়া ও নেশায় আসক্ত হচ্ছে। জনসংখ্যার এরূপ চিত্র কোনো দেশের জন্য মোটেই কল্যাণজনক নয়। এমতাবস্থায় দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। তবে যেখানে সমস্যা, সেখানেই সম্ভাবনা বলে একটা কথা আছে, এই অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে দেশের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলে জনগণ অবশ্যই সম্পদে পরিণত হবে।

একজন শিশু দুটি হাত ও একটি মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তবে শুধু খাওয়ার জন্য একটি পেট নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। অর্থাৎ অধিক জনসংখ্যা মানেই শুধু অন্ন ধ্বংস নয় বরং প্রত্যেককে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে প্রত্যেকের দুটো হাত দেশের উন্নয়নের চেষ্টা করবে এবং তাদের মস্তিষ্ক দেশের উন্নয়নে চিন্তা করবে। এই বিপুল জনসংখ্যাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে সম্পদে পরিণত করা প্রয়োজন।

প্রথমত শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবে শিক্ষাব্যবস্থা যেন এমন না হয় যে, শুধু শিক্ষিত বেকার তৈরি করবে। শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে বাস্তবমুখী। শুধু সরকারি চাকরির আশায় থেকে বয়স শেষে যেন যুবকরা হতাশার সাগরে ডুব না দেয়, সে জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন প্রথম থেকেই আত্মোন্নয়নমূলক কাজে ভূমিকা রাখতে পারে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যুবকদের যেন শুধু কর্মচারী হওয়ার লক্ষ্যে বছরের পর বছর বই গলাধঃকরণ করানো না হয় বরং তারা যেন নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে আরো হাজারজনের কর্মের ব্যবস্থা করতে পারে, সেই অনুপ্রেরণা ও সুযোগ রাখা প্রয়োজন। দেশের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতভাগ সফলতা নিশ্চিত করতে হবে, সেখানেও যেন বেকারত্বের সৃষ্টি না হয়, এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সময়োপযোগী কর্মের বিষয়ে সবাইকে অবগত থাকা প্রয়োজন, আমরা অলরেডি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন সব কাজ ও ব্যবসা অনলাইনমুখী হচ্ছে, ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে বহুকাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। দেশের জনগণকে এসব কাজে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। বৈদেশিক পরনির্ভরশীলতা কমাতে হবে, রূপচর্চা থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট অবদি আমরা নির্ভরশীল বাইরের দেশের ওপর।

এ সুযোগে বাইরের দেশ আমাদের দেশে বাণিজ্য করে বিপুল অংশ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজের দেশের পণ্য ব্যবহার করতে আগ্রহী নই, বাইরের দেশের প্রোডাক্ট আমাদের দেশের প্রোডাক্ট থেকে ফলপ্রসূ মনে করি। আমাদের দেশে এসব পণ্য ভালোমানের উৎপাদন সম্ভব হলে পরনির্ভরশীলতা দূর হবে, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, অন্য দেশে রপ্তানি-বাণিজ্য সৃষ্টি করতে পারলে তো দেশের অর্থনীতিতে বিস্ময়কর পরিবর্তন আসবে। দেশের মানুষকে নিজ দেশের পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। আবার নিজের দেশে উৎপাদন কর্ম বৃদ্ধি হলে বিরাট জনসংখ্যক লোকবল লাগবে কাজের জন্য, এর মাধ্যমে বেকারত্বের অভিশাপ দূর হবে। পরিকল্পিতভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে, যত্রতত্র প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে পানিদূষণ, বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী, তারা খাওয়া-পরার জন্য পুরুষের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। এই বিরাট নারীগোষ্ঠীকে কাজে আগ্রহী করতে হবে। একজন পুরুষের উপার্জনের ওপর পরিবারের দশজন নির্ভর করে। এই নির্ভরশীলতা দূর করে প্রত্যেককে আত্মনির্ভরশীল করতে হবে। নারীকর্মে নিয়োজিত হলে অধিক সন্তান নেওয়া পছন্দ করে না, সে ক্ষেত্রে জনসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। আবার প্রত্যেক জনগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে পারবে। সর্বোপরি, জনগণকে সম্পদে পরিণত করতে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং জনগণকে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। জনসংখ্যাকে সমস্যা থেকে সম্পদে রূপান্তর করতে পারলে দেশের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close