মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ

  ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

মুক্তমত

গুজব ও মিথ্যা তথ্য : এক ভয়াবহ ব্যাধি

মিথ্যা তথ্য এবং গুজবের মধ্যে খুবই সূক্ষ্ম একটি পার্থক্য রয়েছে। এটি নির্ভর করে উদ্দেশ্যের ওপর। মনের অজান্তে যখন কোনো সত্য তথ্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং কোনো পক্ষ বা ব্যক্তিকে ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্য অনুপস্থিত থাকে এবং যেখানে বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্যের পাশাপাশি সঠিক সত্য অন্তর্ভুক্ত থাকে তা-ই ভুল তথ্য। অন্যদিকে কোনো নির্দিষ্ট ঘৃণ্য উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে কোনো জাতি, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়, তাকে অপপ্রচার বা মিথ্যা তথ্য বলে আক্ষায়িত করা হয়।

মিথ্যা তথ্য বা গুজব দুটিই আমাদের সমাজের জন্য অতি মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, গুজব ও তথ্য অপ্রচারের সর্বোত্তম প্ল্যাটফরম হলো অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেখানে কোনো নেতিবাচক তথ্য ভাইরাল হয়ে যায় আমাদের কল্পনারও কম সময়ের মধ্যে। মানুষ তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই শেয়ার করে থাকে, কেউ তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, কেউ তার মতকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য, প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার লক্ষ্যে, নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা সমাজকে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং খামখেয়ালিপনায় পোস্ট বা ছবি শেয়ার করে। কিন্তু এই কাজের মাশুল দিতে কত মসজিদ, মন্দির বিলীন হয়, কত মানুষের স্বপ্ন কাচের মতো ভেঙে যায়, কত প্রাণ বিনা কারণে ঝরে যায়, কত মা-বাবা তাদের সন্তান হারায়, তা শুধু তারাই জানে যারা এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এ দেশের মানুষ কখনোই ভুলতে পারবে না সেসব ঘটনা, যার প্রকৃতি ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে ঘটেছিল, কিছু অসাধু ও বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের কারণে বাংলাদেশের মতো সম্প্রীতির দেশে ধর্ম নিয়ে মারামারি, হানাহানি হওয়া মোটেও কাম্য নয়। বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানার ২০২৩ সালে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ১৯১৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এ সংখ্যা তত দিন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়, যত দিন আমরা সচেতন না হই। কারণ এর বদৌলতে এ বিষয়টি আরো অধিক পরিমাণে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটার, অভিনেত্রী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচতে পারেনি, আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ছবি দিয়ে বিভিন্ন ভুয়া তথ্য প্রচার করছে টিকটক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

এই অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কিছু কাজ করতে হবে, তার মধ্যে ফ্যাক্ট চেক করা অন্যতম, ফ্যাক্ট চেক হলো এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো তথ্য বা ছবির সত্য-মিথ্যা যাচাই করা যায়। ফ্যাক্ট চেক করার জন্য আমরা যেসব কাজ করতে পারি, এর মধ্যে প্রথম বিষয়টি হলো সন্দেহ বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা ছবি যাচাইয়ের জন্য (TinEye), Yandex, Poynter বা গুগলের মাধ্যমে রিভার্স ইমেজ সার্চ করা, এখানে ছবিটির উৎস এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে জানা যাবে। এ ছাড়া Hoaxy এবং CrowdTangle টুলসের মাধ্যমে গুজব কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর উৎস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। আমরা আরো কিছু কাজ করতে পারি যার মাধ্যমে গুজব বা ভুল তথ্য থেকে নিজেকে সুরক্ষা করা যাবে, যেমন সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখি আলোচিত টিভি বা প্রিন্ট মিডিয়ার ফরমেট ব্যবহার করে গুজব রটানোর চেষ্টা করে, এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত টিভি বা সংবাদপত্রের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে তার অস্তিত্ব যাচাই করা। তথ্য সূত্র বিশ্বস্ত হওয়া, তথ্যের বিপরীতে যথেষ্ট প্রমাণ থাকা, তথ্যের সময় ও প্রেক্ষাপট যাচাই করা, বিভিন্ন উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, তথ্যে ব্যবহৃত ভাষা, ফরমেট ও ছবির ধরন বিশ্লেষণ করা। মিথ্যা তথ্য

অনলাইনে সয়লাভ করার আগেই সেই তথ্যের প্রকৃতরূপ অনলাইনে তুলে ধরা, সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলা, দুর্বল মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য শেয়ার না করা। অন্যদিকে সঠিক তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ফ্যাক্ট-চেকিং বিষয়ে অনেক ওয়েবসাইট কাজ করছে, বোম বাংলাদেশ (Boom Bangladesh), বিডি

ফ্যাক্টচেক BD FactCheck, যাচাই Jachai, ফ্যাক্টোয়াচ Factwatch এই প্ল্যাটফরমগুলো বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে থাকে, এই সাইটগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়।

চ্যালেঞ্জের বিষয় হলো, এসব বিষয়ে অনুসরণ করতে হলে প্রতিটি মানুষের কিছু দক্ষতা প্রয়োজন, যা সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে অনুপস্থিত, তাই সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এসব বিষয় তখনই কার্যকর ফল দিতে পারবে, যখন সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হবে। আমরা দেখেছি, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে অনেক অপরাধ দমন করা সম্ভব, তাই সাইবার ক্রাইম সম্পর্ককৃত আদালতের শাস্তি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে হবে, যেন মানুষ সাইবার ক্রাইম করলে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়, তা জানতে পারে এবং অপরাধ থেকে নিজেকে বিরত রাখে।

লেখক : উন্নয়নকর্মী ও লেখক

কোস্ট ফাউন্ডেশন

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close