প্রকাশ ঘোষ বিধান

  ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

পর্যালোচনা

ডাকের সেকাল ও একাল

ডাকঘর, ডাকবাক্স, ডাকপিয়ন বা ডাক হরকরা- এ শব্দগুলো আজকের যুগে খুব বেশি প্রয়োজনীয় না হলেও একসময় মানুষের মন এসব নিয়ে পড়ে থাকত। দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থেকেছে ডাকপিয়নের জন্য। কখন চিঠি নিয়ে আসবে। সে সময় চিঠিই ছিল মানুষের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। সেসব এখন স্মৃতি। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সবার হাতে রয়েছে বার্তাবাহক স্মার্টফোন। এখন আধুনিকতার আলোয় পুরোনো স্মৃতিতে ঠাঁই নিয়েছে। এতে ডাকবাক্স, পোস্ট অফিস, ডাকপিয়ন- এসব যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার এক অনন্য ছোটগল্প। তার একটি প্রতীকী বা রূপক নাটকের নামও দিয়েছেন ডাকঘর। সুকান্ত ডাক হরকরাদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে লিখেছেন কবিতা রানার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এক নীতিবান ডাক বাহক ও তার বিপথগামী সন্তানকে নিয়ে ডাক হরকরা নামের গল্প লিখেছেন। রানারের হাতে বর্ষা বা বল্লম এখন আর দেখা যায় না, রাতের অন্ধকারে ঝুম-ঝুম ঘণ্টার আওয়াজও আর পাওয়া যায় না, তবু রানার আজও আছে দেশের সর্বত্র।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি গ্রাস করেছে। হাতে লেখা চিঠির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ই-মেল, হোয়াটসঅ্যাপেই সব কথা বলা হয়ে যায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ডাকব্যবস্থার অন্য এক গুরুত্ব থেকেই গিয়েছে। ডাকে হয়তো চিঠি পাঠানো হয় না, কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিস এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠাতে গেলে ভরসাযোগ্য নিরাপদব্যবস্থা শতাব্দীপ্রাচীন এই ডাক। এই ডাকব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই ৯ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব ডাক দিবস।

১৮৭৪ সালের এই দিনে সুইজারল্যান্ডের বের্ন শহরে বিশ্ব ডাক সংস্থার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে স্মরণ করে প্রতি বছর ৯ অক্টোবর বিশ্ব জুড়ে পালন করা হয় ডাক দিবস। ৯ অক্টোবর প্রথম বিশ্ব ডাক দিবস ঘোষণা করা হয় ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে ইউপিইউ কংগ্রেসে। ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য শ্রী আনন্দ মোহন নারুলা প্রস্তাবটি পেশ করেন। সেই থেকে ডাক পরিষেবার গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য বিশ্ব ডাক দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব ডাক সংস্থা চিঠি লিখে তথ্য আদান-প্রদান এবং যোগাযোগের মাধ্যমে ডাক বিভাগে বৈশ্বিক বিপ্লবের সূচনা করে। ডাকসেবার প্রচার এবং প্রসার এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য।

উপমহাদেশে প্রাচীনতম ডাক যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে বৈদিক গ্রন্ধ অথর্ববেদে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে নল-দময়ন্তীর হাঁস, রামায়ণে হনুমান, মহাভারতে বিদুর এবং আনারকলীর হরিণ প্রভৃতি প্রাণীকে দূতিয়ালির কাজে ব্যবহার হতে দেখা যায়। বাংলা ডাক কথাটির শব্দার্থ আহ্বান করা অথবা মনোযোগ আকর্ষণ করা। এ শব্দ থেকে ডাকব্যবস্থা, ডাকঘর, ডাক হরকরা এবং ডাক মাশুল শব্দগুলোর উদ্ভব হয়েছে। এ অঞ্চলে প্রচীনকাল থেকেই সংবাদ আদান-প্রদান ব্যবস্থা চালু ছিল। বিভিন্ন সাহিত্য, লোকগাথা ও ছড়া-কবিতায় দেখা যায়, আদিকালে একস্থান থেকে অন্যস্থানে আপনজনের নিকট খবরাদি প্রেরণের জন্য দূত এবং কবুতর ব্যবহার করা হতো। প্রাচীনকালে দূতের সামাজিক অবস্থান উচ্চে ছিল।

বার্তা প্রেরণের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম আসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে ৩২১ থেকে ২৯৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার বিরাট সাম্রাজ্যকে শাসনব্যবস্থার সুবিধার জন্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। তিনিই প্রথম প্রাদেশিক রাজধানীর সঙ্গে সাম্রাজ্যের মূল রাজধানীর বার্তা বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনিই প্রথম শুরু করেন পায়রা মারফত বার্তা আদান-প্রদানের ব্যবস্থা। শুরু হয় মানুষ ছাড়া কোনো মাধ্যমের দ্বারা এক জায়গা থেকে দূরবর্তী কোনো জায়গায় বার্তা প্রেরণ। এ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত থাকে। পায়রা ছাড়াও ঈগল বা অন্যান্য অনেক ধরনের পাখির ব্যবহার দেখা যায় ইতিহাসে। এই পদ্ধতিতে বার্তা প্রেরণ মূলত যুদ্ধক্ষেত্রের বা অন্য কোনো গোপন খবর পাঠানোর জন্য কাজে লাগানো হতো।

৬০২-৬৮০ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মুয়াবিয়া দাপ্তরিক ডাক যোগাযোগের জন্য দেওয়ান-ই-বারইদ বা ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন কাবুল থেকে দিল্লি হয়ে ৬টি মেইল রুটে ৯৩০টি পোস্টাল স্টেশন ছিল। ১১৮৬-১২০৬ খ্রিস্টাব্দে ঘুরি সাম্রাজ্যে উটের মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা তখন শুরু হয়। ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের শাসনামলে ডাকব্যবস্থার ক্রমোন্নতির একটা ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি দিল্লি থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত ঘোড়ার ডাকব্যবস্থা চালু করেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজী ১২৯৬ সালে ঘোড়ায় চড়ে এবং পায়ে হাঁটা ডাকবাহকের সাহায্যে তথ্য পরিবহনের ব্যবস্থা ও ডাকচৌকি স্থাপন করেন। ১৬০০ সাল থেকে প্রথম জাতীয় ডাকব্যবস্থা অনেক দেশে উত্থিত হতে শুরু করে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে ১৬১০ সাল থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দিল্লির ডাক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ডাক গ্রহণ ও প্রেরণের জন্য ডাকচৌকির দারোগা বা সুপারিনটেন্ডেন্ট নিয়োগ করা হয়।

১৭৬৬ সালে রবার্ট ক্লাইভ প্রথমবারের মতো ডাকব্যবস্থার সংস্কার করেন। কলকাতায় একজন পোস্টমাস্টার নিয়োগ দেওয়া হয়, কলকাতার সঙ্গে ছয়টি ডাক যোগাযোগ কেন্দ্রের সংযোগ স্থাপন করা হয়, তবে প্রধান সংযোগ ছিল ঢাকা ও পাটনার সঙ্গে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো ক্লাইভের ডাক। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় ১৭৭৪ সালের ১৭ মার্চ কলকাতায় জিপিও বা জেনারেল পোস্ট অফিস স্থাপন করা হয়। ১৭৯১ সালে ডাক বহনের মাশুল পুনর্বিন্যাস করা হয় এবং কলকাতা থেকে ঢাকা তিন আনা, চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছয় আনা মাশুল ধার্য করা হয়। ১৭৯৩ সালে এক বিধি জারির মাধ্যমে ডাকব্যবস্থা আরো সংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক রূপ লাভ করে।

১৮৮০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নিয়মিত রেল মেইল সার্ভিস চালু হয়। ১৮৬৬ সালে পাস করা পোস্ট অফিস আইন ১৮৬৭ থেকে কার্যকর হয়। ১৮৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় সদর দপ্তর স্থাপন করে পোস্ট অফিসের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা চালু করা হয় এবং চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে বিলি বা ডেলিভারি অফিস স্থাপন করা হয়। ১৮৭৯ সালে সর্বপ্রথম এক পয়সা মূল্যের পোস্টকার্ড চালু করা হয় এবং তৎকালীন বিশ্বে এটাই ছিল ডাক বহনের ন্যূনতম হার। ১৮৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে এক আনা মূল্যের এমবস্ড খাম চালু করা হয়। ১৮৭৭ সালের ১ আগস্ট থেকে রেজিস্ট্রার ডাক এবং একই সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ভ্যাল্যু পেয়েবল ডাক ও ১৮৭৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বিমাকৃত ডাক চালু করা হয়। ১৮৫৬-৫৭ সালে প্রথম চিঠি ফেলার বাক্স বা লেটার বক্স চালু হয়।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হয়। এতে বাংলাও বিভক্ত হয়ে যায় এবং অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা নিয়ে পূর্ববাংলা প্রদেশ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৯ জুলাই তারিখে পাকিস্তানের নিজস্ব ডাকটিকিট এবং একই সালের ১৪ আগস্ট নিয়মিত ডাকটিকিট সিরিজ চালু করা হয়। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ডাকব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। জেলা শহরগুলোয় অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ সাব-ডাকঘরগুলোর উন্নয়ন করে প্রধান ডাকঘরে রূপান্তর করা হয়। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ডাকটিকিট ও অন্যান্য কাগজপত্র বাংলা হরফে মুদ্রিত হয়। ১৯৫৯ সালে ঢাকা-খুলনা এবং চট্টগ্রামে নতুন জেনারেল ডাকঘর স্থাপন করা হয়। ১৯৬১ সালে পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে টাকা-আনা-পাইয়ের পরিবর্তে মুদ্রার নতুন একক নির্ধারণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে ঢাকা জেনারেল পোস্ট অফিসের জন্য নতুন কমপ্লেক্স স্থাপন করা হয়। ১৯৬৯ সালে কমলাপুর রেলস্টেশন স্থাপিত হলে রেলওয়ে মেইল সার্ভিস সেখানে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে ডাকব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ৫০টি ফিল্ড পোস্ট অফিস চালুর মাধ্যমে এবং মুক্তিবাহিনীর সার্বিক বা আংশিক পরিচালনায় ডাকব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর মুজিবনগর সরকারের ফিল্ড পোস্ট অফিসগুলো বন্ধ করে দেশের স্থায়ী ডাকব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করা হয়।

১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই ভারতীয় নাগরিক বিমান মল্লিকের ডিজাইন করা আটটি ডাকটিকিট কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। কূটনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে এই উদ্যোগ গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার। দেশে ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের উৎসাহিত করার জন্য ১৯৭২ সালেই ডাকবিভাগের আনুকূল্যে ডাকটিকিট সংগ্রাহকদের একত্র করে একটি ডাকটিকিট সংগ্রাহক সমিতি গঠন করা হয়। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ডাকটিকিট ভারতের নাসিক, ইংল্যন্ডের ব্র্যাডবেরি উইলকিনসন, হ্যারিসন অ্যান্ড সন্স, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশার অ্যান্ড কোংসহ স্পেন, অস্ট্রিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন সিকিউরিটি প্রেস থেকে ছাপিয়ে আনা হতো। ১৯৮৯ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নিজস্ব নিরাপত্তা ছাপাখানা স্থাপনের পর থেকে দেশের সব ডাকটিকিট ও স্টেশনারি অর্থাৎ খাম, পোস্টকার্ড প্রভৃতি দ্রব্য এখান থেকেই ছাপানো হয়। দেশের ১০ হাজার ডাকঘরে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মী ডাকসেবায় নিয়োজিত। দেশে ৮ হাজার ৫০০ ডাকঘরকে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় তৃণমূল জনগোষ্ঠী সরকারের ২০০ ডিজিটাল সেবা পাচ্ছে। এতে উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডের ডিজিটাইজেশনের ভিত তৈরি হয়েছে। একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশ্নে ডাকব্যবস্থার অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close