গনেশ চন্দ্র হাওলাদার
শুভ বিজয়া
সার্বজনীন সংস্কৃতির মেলবন্ধন দুর্গোৎসব
আজ শুভ বিজয়া দশমী। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ও প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার সমাপ্তিপর্ব ‘দেবীদুর্গার বিসর্জন’। এ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবীদুর্গার পৃথিবীতে অবস্থান এ বছরের মতো শেষ হবে। মর্ত্য থেকে দেবী ফিরে যাবেন কৈলাশে। নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গিয়ে জানিয়ে দেবে তার প্রত্যাবর্তনের খবর।
আবহমানকাল ধরে দুর্গোৎসবে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, অজপাড়াগাঁ থেকে তিলোত্তমা রাজধানীতে স্থাপিত আলোকোজ্জ্বল অসংখ্য মণ্ডপে চিরায়ত ঢাকের তালে তালে আলোড়িত হয়েছে মানুষের হৃদয়। পূজার বর্ণিল আনুষ্ঠানিকতা, আড়ম্বরপূর্ণ ও জাঁকজমকতায় কয়েকটা দিন সবাইকে আনন্দ সাগরে অবগাহিত করে রাখে। কবিগুরুর ভাষায়- ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ দেবীদুর্গা আজ চলে যাবেন, তাকে বিদায় দিতেই হবে। বিদায়ের বেদনাকে হাসির আড়ালে চাপা দিয়ে মণ্ডপে মণ্ডপে সিঁদুর খেলা, মিষ্টিমুখ, আনন্দ শোভাযাত্রায় বাদ্য বাদনায় বাঙালি হৃদয় উদ্বেলিত হলেও বিদায়ের কষ্ট অনুভব হবে আরো বেশি করে।
দেবীদুর্গা মহাশক্তির প্রতিমূর্তি। তিনি জগতের কল্যাণার্থে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে দেবতা ও মানুষদের বিপদে রক্ষা করেছেন। ‘দ’ অর্থ দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অর্থ পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। তিনি সব দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। শারদীয় দুর্গাপূজায় দেবীকে মহাশক্তির একটি উগ্ররূপ মনে করা হয়। জগতের দেবীদুর্গার দশ হাত। তার বাহন সিংহ। মহিষাসুরমর্দিনী-মূর্তিতে তাকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর অন্যরূপ।
সনাতন হিন্দুধর্মের শাস্ত্র গ্রন্থের বর্ণনা ও বিশ্বাস মতে, সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা কৃষ্ণ বৈকুণ্ঠের আদি-বৃন্দাবনের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শিব বিপদে পড়লে তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। তবে এসব পূজা বসন্তকালে হয়েছিল। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, মহাপরাক্রমশালী লঙ্কারাজ রাবণের হাতে বন্দি, স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারে চলমান যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য ত্রেতাযুগের অবতার রাম প্রথম শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাদের পূজার যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে তাই এই পূজার নাম হয় ‘অকালবোধন’। কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষরা নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপূজা করে আসছে।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গোৎসব পালন করা হয়ে থাকে। বসন্তকালের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা ও শরৎকালের দুর্গাপূজা শারদিয়া দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, নেপাল ও পাশ্চাত্য, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশে বাঙালিরা কর্মসূত্রে অবস্থান করেন, সেখানেও মহাসমারোহে দুর্গোৎসব পালিত
হয়ে থাকে। দুর্গার আরাধনা বাংলা, অসম এবং বিহারের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের অন্যত্র দুর্গাপূজা নবরাত্র
উৎসব রূপে উদযাপিত হয়। এই কারণে সারা বিশ্বের কাছেই বর্তমানে বাংলার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে শারদীয়
দুর্গোৎসব। বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজা সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদিয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপূজা মূলত দশ দিনের উৎসব, যার মধ্যে শেষ পাঁচটি দিন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়াদশমী নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় ‘দেবীপক্ষ’। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হলো কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন ধন সম্পদের দেবীলক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
বাংলাদেশে এ বছর দুর্গাদেবীর আবাহন তথা মহালয়ার মধ্য দিয়ে ২ অক্টোবর শুরু হয়েছে দেবীর আরাধনা। সাধারণত মহালয়ার ছয় দিন পরই হয় দেবী দুর্গার বোধন। অর্থাৎ মহালয়ার পর থেকে দেবীর আগমনের ঘণ্টা বাজে। ২৪ আশ্বিন ১৪৩১ বাং বুধবার (৯ অক্টোবর ২০২৪) ‘দুর্গাষষ্ঠী’ শ্রীশ্রী শারদীয় দুর্গাদেবীর ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা প্রশস্তা, সায়ং কালে দেবীর বোধন আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠিকতা শুরু হয়েছে। ২৫ আশ্বিন বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) মহাসপ্তমীতে শ্রীশ্রী শারদীয় দুর্গাদেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমীবিহিত পূজা এবং দেবীর দোলায় বা পালকিতে আগমন, ২৬ আশ্বিন শুক্রবার (১১ অক্টোবর) মহাষ্টমী শ্রীশ্রী শারদীয় দুর্গাদেবীর মহাষ্টম্যাদি কল্পারম্ভ, বিহিত পূজা, বীরাষ্টমী ব্রত ও মহাষ্টমীর ব্রতোপবাস, সন্ধিপূজা ও বলিদান। ২৭ আশ্বিন শনিবার (১২ অক্টোবর) মহানবমী শ্রীশ্রী শারদীয় দুর্গাদেবীর কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা প্রশস্তা দেবীর নবরাত্রিক ব্রত সমাপ্ত এবং এ বছর একই দিনে অর্থাৎ ১২ অক্টোবর ‘মহাদশমী’ শ্রীশ্রী শারদীয় দুর্গাদেবীর দশমীবিহিত পূজা সমাপনান্তে দর্পণে বিসর্জন, দেবীর ঘোটক বা ঘোড়ায় গমন, বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজার মধ্য দিয়ে চার দিনব্যাপী দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয়েছে। ২৮ আশ্বিন রবিবার (১৩ অক্টোবর) প্রতিমা বিসর্জন অর্থাৎ বিজয়দশমী পালিত হবে। অষ্টমী তিথিতে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই মণ্ডপে মণ্ডপে বিশেষ ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, আরতি প্রতিযোগিতা ও প্রসাদ বিতরণ করা হয়েছে। শাস্ত্র মতে বলা হয়, দোলায় বা পালকিতে দেবীদুর্গার আগমন হলে, তার ফল মহামারি ও দুর্ভোগের সমান। ঘোটক বা ঘোড়ায় দেবীর গমন-আগমনে ছত্রভঙ্গ, ছন্নছাড়া, ধ্বংসাত্মক ফলাফল হয়। যদিও দেবীদুর্গা কখনো দুর্গতিনাশিনী, কখনো সংকটনাশিনী।
বিজয়া দশমী উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। এ বছরই প্রথম বাংলাদেশে দুুর্গাপূজা উপলক্ষে চার দিনের সরকারি ছুটি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা এ উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন। সংবাদপত্রগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করেছে। ‘সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজার দিন সকালে মায়ের পুষ্পাঞ্জলি সরাসরি সম্প্রচার করেছে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল। একই সময় মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি, শ্রীশ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির নামের ফেসবুক পেজ থেকে মায়ের পুষ্পাঞ্জলি সরাসরি সম্প্র্রচার করা হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিক বিশেষ উদ্যোগে প্রতিটি মণ্ডপে আনন্দঘন পরিবেশে দুর্গোসৎব পালিত হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া সারা দেশে বিশেষ টিম সার্বক্ষণিক টহল দিয়েছে। এ বছরই প্রথম নিরাপত্তার জন্য আকাশে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে টহল এবং বিসর্জনের সময়ে সরকারিভাবে ডুবুরি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রশাসনের নির্দেশনায় পূজা কমিটির উদ্যোগে প্রতিটি পূজামণ্ডপে সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও সর্বস্তরের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও ছাত্রসংগঠন পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে এবার ৩১ হাজার ৪৬১টি মণ্ডপে ও মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ৪০৮টি দুর্গাপূজা হয়েছিল। সে হিসেবে এবার ৯৪৭টি দুর্গাপূজা কম হচ্ছে। ঢাকা মহানগরে এবার ২৫২টি পূজা হচ্ছে। গত বছর ঢাকা মহানগরে ২৪৮টি পূজার আয়োজন হয়েছিল। সে হিসেবে এবার ঢাকা মহানগরে ৪টি পূজা বেড়েছে।
সারা দেশে বিজয়া দশমী বেশ জাঁকজমক ও আড়ম্বরভাবে পালিত হচ্ছে। বিজয় শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিসর্জনের জন্য রাজধানী ঢাকায় বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটের বীণাস্মৃতি স্নানঘাটসহ অন্যান্য স্থানে নির্ধারিতে জলাশয়ে ট্রাকে করে ভক্তরা ঢাকঢোল ও বাদ্য-বাজনায় আনন্দ করতে করতে বিসর্জনের ধর্মীয় রীতি মেনে বিকেল ৫টার মধ্যে বিসর্জন দেবেন। বিজয়াদশমীতে প্রাণপ্রিয় দেবী মা দুর্গাকে বিদায় কিংবা বিসর্জনের ধর্মীয় রীতির মধ্য দিয়ে আত্মত্যাগের মহান শিক্ষাকে আমাদের হৃদয়ে পরিস্ফুটিত করে রাখি। আমাদের মনের সব কলুষতা, আসুরিকতা, অন্যায় আচরণকে বিসর্জন দিয়ে ত্যাগের মানসিকতায় ভালোবাসার বন্ধনে জগতের প্রতিটি মানুষ যাতে তার নিজ নিজ স্বকীয়তা ও ধর্মীয় বিশ্বাসে সুদৃঢ় থেকে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় শান্তিময় জীবন কাটাতে পারে, এ পৃথিবীতে যাতে সব জীব সুন্দর ও শাশ্বতরূপে নিজেকে বিকশিত করতে পারে, বিজয়ার এ শুভক্ষণে সৃষ্টিকর্তার কাছে সে আশীর্বাদ প্রার্থনা করছি। সবার জীবন শান্তিময় ও সুন্দর হোক।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"