মিজানুর রহমান মিজান
দৃষ্টিপাত
তথ্যের মুক্তপ্রবাহ : গণতন্ত্রের অগ্রদূত
গণমাধ্যমের ইতিহাস মানবসভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতীতে, সংবাদ পরিবেশন ছিল সীমিত এবং মূলত পত্রিকা ও রেডিওর মাধ্যমে। তখন তথ্যের প্রবাহ ছিল ধীর এবং সংবাদপাঠক বা শ্রোতাদের হাতে আসতে সময় লাগত। ওই সময়ের গণমাধ্যমে সাংবাদিকতার মান অনেকাংশে তথ্যকেন্দ্রিক ছিল, যেখানে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা গুরুত্ব পেত। বর্তমানে, ডিজিটাল যুগের আবির্ভাবে গণমাধ্যম বিপ্লবী পরিবর্তনের সম্মুখীন। ইন্টারনেটের বিস্তার, সামাজিক মাধ্যমের উত্থান এবং মোবাইল প্রযুক্তির কারণে তথ্যের প্রবাহ দ্রুত হয়েছে। এখন বিশ্বের যেকোনো কোণে ঘটছে, তা নিমিষে পৌঁছে যাচ্ছে হাজারো মানুষের কাছে। এতে গণমাধ্যমের ভূমিকা পরিবর্তিত হয়েছে; এখন সংবাদ পরিবেশন শুধু তথ্য বিতরণ নয়, বরং জনমত গঠন এবং সমাজের বিভিন্ন সমস্যার আলোচনার ক্ষেত্রেও পরিণত হয়েছে।
ভবিষ্যতে, গণমাধ্যমের ভূমিকা আরো জটিল হতে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশন সাংবাদিকতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তবে, এর পাশাপাশি তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং নির্ভরযোগ্যতা রক্ষা করাও চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে যাবে। মিথ্যা খবর এবং ফেক নিউজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। তা ছাড়া, গণমাধ্যমের দায়িত্ব হবে সমাজের দরিদ্র ও অবহেলিত শ্রেণির কণ্ঠস্বর তুলে ধরা। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটির মাধ্যমে তথ্য উপস্থাপনা নতুন অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করবে। এক কথায়, গণমাধ্যমের অতীত শিক্ষা দেয়, বর্তমানের অভিজ্ঞতা নতুন পথের সন্ধান করে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করে। গণমাধ্যমের উন্নতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজও নতুন নতুন ভাবনা ও উদ্যোগে এগিয়ে যাবে।
তবে রাজনৈতিক দলীয়করণের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে, যা সাংবাদিকতা ও তথ্যের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করে। গণমাধ্যম রাজনৈতিক দলীয়করণের ফলে নিরপেক্ষতার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম যখন কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে, তখন জনগণের তথ্যের সঠিকতা এবং স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া মিথ্যা তথ্যের প্রচার দিন দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা বা অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশন করে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে।
বর্তমান গণমাধ্যমে অপপ্রচার একটি মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে খাটো করার জন্য সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করা হলে, তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অসংবিধানিক চাপ সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তখন জনগণের প্রকৃত মতামত বিকৃত হচ্ছে। গণমাধ্যম রাজনৈতিক দলীয়করণের ফলে সাংবাদিকদের ওপর দলীয় চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। সাংবাদিকরা যদি রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্রভাবিত হন, তাহলে তাদের স্বাধীনতা এবং পেশাগত মানসিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমতাবস্থায় সাংবাদিকরা সঠিক তথ্য প্রকাশে ব্যর্থ হয়।
একটি সুষ্ঠু-সুন্দর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রয়োজন। সে জন্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আইন ও নীতিমালা জোরদার করা উচিত। তা ছাড়া সংবাদ প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ নীতিপ্রণয়ন করা, যা পক্ষপাতিত্বমুক্ত সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিত করবে এবং জনগণকে মিথ্যা তথ্য শনাক্ত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মধ্যে তুলনা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সাংবাদিকতা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা, যা স্বচ্ছতা ও সত্যতার জন্য সহায়ক হবে এবং রাজনৈতিক দলীয়করণের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই হলো সত্যিকার সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি।
একটি স্বাধীন গণমাধ্যম একটি সুস্থ সমাজ ও দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন গণমাধ্যম তথ্যের সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য প্রবাহ নিশ্চিত করে। এটি নাগরিকদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে তুলতে হবে। সংবাদমাধ্যম সরকারের কার্যক্রম ও নীতির সমালোচনা করে। সংবাদমাধ্যম সরকারকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য করে। তা ছাড়া গণমাধ্যম সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, উন্নয়ন প্রকল্প ও অধিকার নিয়ে জনগণকে সচেতন করে। এটি একটি তথ্যমূলক পরিবেশ তৈরি করে। একটি স্বাধীন গণমাধ্যম বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতামত তুলে ধরে, যা সমাজে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে স্বাধীন সাংবাদিকতা মানবাধিকারের লঙ্ঘনকে প্রমাণ করে এবং তা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং সুশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম সমাজের সমস্যা তুলে ধরে, যা সমাধানের জন্য আলোচনা এবং উদ্যোগের জন্ম দেয়। সার্বিকভাবে, স্বাধীন গণমাধ্যম একটি সুন্দর এবং উন্নত দেশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি নাগরিকের অধিকারকে সুরক্ষা দেয় এবং সমাজে ন্যায় ও সততার পরিবেশ সৃষ্টি করে।
একটি স্বাধীন ও জনগণের জন্য কল্যাণকর গণমাধ্যম তৈরি করার জন্য অবশ্যই দলীয় পত্রপত্রিকাসহ সব ধরনের টেলিভিশন বন্ধ করতে হবে। দলীয় পত্রিকা, যা বিশেষত রাজনৈতিক দলের স্বার্থ রক্ষা ও প্রচারার্থে পরিচালিত হয়, তার বন্ধ হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ধরনের গণমাধ্যম বন্ধ না হলে সঠিক সংবাদ প্রকাশ সব সময় বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ দলীয় পত্রিকা সাধারণত নিরপেক্ষ সংবাদ প্রদান করে না। এটি বন্ধ হলে সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব কমে আসবে এবং সঠিক তথ্য প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ বাড়বে। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলের স্বার্থে পরিচালিত পত্রিকা গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর বন্ধ হওয়া গণতান্ত্রিক পরিবেশ উন্নত করতে সহায়তা করে। দলীয় পত্রিকার মাধ্যমে মিথ্যা বা অর্ধসত্য সংবাদ প্রচারিত হয়। বন্ধ হলে সত্য তথ্যের প্রচার বৃদ্ধি পাবে। তা ছাড়া দলীয় পত্রিকা জনমতকে বিকৃত করতে পারে। এর বন্ধ হওয়া সমাজে সত্য ও বৈচিত্র্যময় মতামত তৈরি করবে এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা ও প্রকৃত সাংবাদিকতার মান বৃদ্ধি পাবে, যা সমাজের জন্য উপকার। দলীয় নিয়ন্ত্রণের অবসান সাংবাদিকদের পেশাদারিকে রক্ষা করবে এবং তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করবে। এই কারণে, দলীয় পত্রিকার বন্ধ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সমাজের সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে।
দিন দিন সংবাদমাধ্যম আগাছার মতো বেড়ে উঠছে। সে জন্য ভুল সংবাদ প্রচারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সংবাদমাধ্যমের আইনগত সুরক্ষার জন্য গণমাধ্যমের নিবন্ধন প্রয়োজন। এই নিবন্ধন সাংবাদিকদের আইনগত সুরক্ষা প্রদান করে, যা তাদের কাজকে স্বীকৃতি দেবে এবং নিবন্ধনের মাধ্যমে সংবাদ মাধ্যমের পেশাদারি নিশ্চিত করতে হয়, যা মান ও মানদণ্ড বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আগাছার মতো সংবাদমাধ্যমে বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি কার্যকর করতে হবে, যা মানসম্মত সংবাদ পরিবেশন নিশ্চিত করবে। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক সহায়তা শুধু নিবন্ধিত সংবাদমাধ্যমগুলো পাবে। নিবন্ধিত সংবাদমাধ্যমগুলো শুধু সরকারি বা বেসরকারি অনুদান ও সহায়তার সুযোগ পাবে। তা ছাড়া সংবাদকর্মীদের সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আর এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। অতএব, নিবন্ধন সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রমকে আইনগতভাবে বৈধ এবং সুশৃঙ্খল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের গুরুত্ব অত্যন্ত অপরিসীম। গণমাধ্যম একটি সমাজের উন্নয়ন, গণতন্ত্রের চর্চা এবং নাগরিক সচেতনতার জন্য অপরিহার্য। এটি জনগণের মতামত, তথ্য ও ধারণাগুলো প্রকাশের সুযোগ প্রদান করে এবং সরকারকে জবাবদিহির জন্য বাধ্য করে। স্বাধীন গণমাধ্যম মানবাধিকার রক্ষা, দুর্নীতিপ্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া এটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধ তৈরি করে এবং সমাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে। স্বাধীন গণমাধ্যম বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও সমাজের উন্নয়নে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে সুন্দর ও জনগণের কল্যাণকর বাংলাদেশ গঠনে সহায়তা করবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"