জিন্নাতুন নেসা (শান্তা)
মুক্তমত
বৃক্ষ দিয়ে সাজাই দেশ সমৃদ্ধ করি বাংলাদেশ
প্রাণীদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন। যার একমাত্র উৎস বৃক্ষ। অথচ আমরা কীভাবে নির্বিচারে নিধন করছি অরণ্য, যত্রতত্র কেটে ফেলছি বৃক্ষ! যার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে বাড়ছে গ্রীষ্মকালে দাবদাহ আর শীতকালে শীতের তীব্রতা। দিনপঞ্জিকা অনুসারে আর ঋতু আসে না। বসন্তে আর পাখি ডাকে না, শিমুল ফোটে না। তেমন আর দেখা মেলে না জাতীয় পাখি দোয়েলের, শোনা যায় না পাখির কিচিরমিচির শব্দ, কোকিলের মধুর গান বা শরতের শিশিরে ভেজা শিউলি সকাল। কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে সবকিছু। জোনাকিরা লুকিয়ে গেছে কোনো এক অজানা দিগন্তে। কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন গ্যাস বৃদ্ধিতে সূর্যরশ্মির তাপ আর বায়ুমণ্ডল ভেদ করতে পারছে না। ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ব্যস্ত ওজোনস্তর নষ্ট করতে। এদিকে অতি বেগুনিরশ্মির প্রভাবে পুড়েছে মানুষের ত্বক, বাড়ছে ত্বক ক্যানসারের সম্ভাবনা। গলছে অ্যান্টার্কটিকার বরফ, সংকটে আজ বন্যপ্রাণ।
পৃথিবীর কক্ষমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেন্টিমিটার। সেখানে বাংলাদেশ গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা থাকত ২৭.৮ ডিগ্রি সেন্টিমিটার আর শীতকালে থাকত ১৭.৭ ডিগ্রি সেন্টিমিটার। কিন্তু এখন গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪০/৪২ ডিগ্রি সেন্টিমিটার। শীতকালে ১০/১১ ডিগ্রি সেন্টিমিটার দেখা যাচ্ছে। পঞ্চগড়ে তো এবার ৫ ডিগ্রি সেন্টিমিটারে পর্যন্তও নেমে এসেছে। একটি দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে বৃক্ষ নিধন করতে করতে বনভূমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫.৫৮ ভাগ। বৃক্ষনিধনের ফলে তাপমাত্রা এই চরম পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা বৃক্ষরোপণ না করে এই তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচতে ঘরে ঘরে এসি, ফ্যানের ব্যবহার বৃদ্ধি করছি। শীতকালে হিটারের ব্যবহার বাড়াচ্ছি। কিন্তু তবুও রক্ষা মিলছে না গ্রীষ্মের দাবদাহ ও শীতের তীব্রতা থেকে। দেখা দিচ্ছে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাড়ছে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি।
বৃক্ষ হলো পৃথিবীর আদি প্রাণ। এই আদি প্রাণ মৃত্তিকা থেকে তাদের প্রাণরস আহরণ করে, নিজেকে উজ্জীবিত করে, পত্রে, পুষ্পে ও ফলে সমৃদ্ধ করে এই ধরণীকে। রক্ষা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক মানুষ আজ বৃক্ষ নিধন করতে ব্যস্ত। নিজেদের পার্থিব উন্নতির লক্ষ্যে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বসতবাড়ি, কল-কারখানা, ইটভাটা নির্মাণের জন্য গাছপালা কাটছে।
রাস্তাঘাট পাকা করতেও রাস্তার পাশের গাছগুলো কাটা হচ্ছে এবং কাটার জন্য নাম্বারিং করা হচ্ছে গাছ। এ ছাড়া আসবাবপত্র, কাঠখড়ির জন্য গাছ কাটা হচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী টাকার জন্য বন থেকে গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে। মানব জীবনের সঙ্গে বৃক্ষের সম্পর্ক অত্যন্ত সুগভীর। তাই বৃক্ষকে মানব জীবনের ছায়াস্বরূপ বলা হয়। বৃক্ষ আমাদের নীরব বন্ধু, যা আমাদের নিত্যপ্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকার করে বাঁচিয়ে রেখেছে। বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেন দিয়ে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। আমাদের খাবার জোগায়। তা ছাড়া আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার কাগজ বৃক্ষ থেকেই তৈরি হয়। তৈরি হয় ধুনা, রেজিন, গাম, কুইন, কর্পূর, তারপিন তেল, রাবার ইত্যাদি। বনভূমি থেকে মধু ও মোম পাওয়া যায়। বৃক্ষ আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে। বাতাসে জলীয়বাষ্প ধারণক্ষমতা বাড়িয়ে আবহাওয়াকে শীতল করে ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের সাহায্য করে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, নদীভাঙন রোধ করে এবং বিভিন্ন ঔষধি উদ্ভিদ থেকে ওষুধ পাওয়া যায়। তাই নিয়ন্ত্রিতভাবে রোপণ করতে হবে বৃক্ষ এবং বন্ধ করতে হবে বৃক্ষ নিধন। প্রয়োজন একটি গাছ কাটলে দুটি গাছ লাগাতে হবে। সঠিক সময়ে সম্মিলিত চেষ্টায় বৃক্ষরোপণ করলে এই দাবদাহ থেকে রক্ষা মিলবে। তবে ট্রেন্ডিং অনুসরণ করে বৃক্ষরোপণ করা যাবে না। বৃক্ষ কোনো জড়বস্তু নয় যে আবেগের বসে কিনে এনে রোপণ করলেই কাজ শেষ। বৃক্ষের প্রয়োজন যত্ন, পানি। যত্নের অভাবে, তীব্র তাপে মরে যাবে একটি গাছ, তার চেয়ে নার্সারিতেই সুরক্ষিত থাকুক চারা। বিভিন্ন সংগঠন-সেমিনারের মাধ্যমে মানুষকে গাছ রোপণ সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে এবং বৃক্ষ নিধনের করুণ পরিণতি সম্পর্কে অবগত করা যেতে পারে। স্কুল, কলেজে গাছ লাগিয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের গাছের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে পারে। সাপ্তাহিক বৃক্ষমেলার আয়োজন করে, উপহারস্বরূপ গাছ দিয়ে, বৃক্ষরোপণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমেও মানুষকে বৃক্ষরোপণের প্রতি আগ্রহী করা যেতে পারে। প্রত্যেক ঈদে ছুটিতে বাসায় ফিরে নিজ নিজ উদ্যোগে গাছ লাগানো যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে ভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে চারা রোপণের পাশাপাশি গাছ কাটার বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা যেতে পারে। তবে সরকার ও জনসাধারণের সম্মিলিত চেষ্টার পুনরায় সবুজ হতে পারে দেশ। তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগে বৃষ্টিপাতের সময় নতুন চারা রোপণ করি, পরিবেশবান্ধব পৃথিবী গড়ি।
পৃথিবীর এন্ট্রপি বাড়ছে। বাড়ছে গ্রিনহাউস গ্যাস। যদি এভাবে নির্বিচারে নিধন করা হয় বৃক্ষ, তবে শিগগিরই মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নত জীবনের জন্য দালানকোঠা, কল-কারখানা নির্মাণ করা হচ্ছে। তারাই আদি প্রজন্মকে দোষারোপ করে বলবে, তাদের বাসযোগ্য করে যেতে পারেনি এই পৃথিবী। তাই নিজেদের জন্য এবং ভবিষ্যতে প্রজন্মের কথা ভেবে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করি, নতুন চারা রোপণ করি। বৃক্ষ বাঁচলে, বাঁচবে পৃথিবী, বাঁচবে মানুষ, প্রাণিকুল। আসুন সবাই একত্রে বলি বৃক্ষ দিয়ে সাজাই দেশ, সমৃদ্ধ করি বাংলাদেশ।
লেখক : শিক্ষার্থী, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
"