কে এম মাসুম বিল্লাহ
দৃষ্টিপাত
শিক্ষা খাতের বৈষম্য দূরীকরণ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘ওঠো, জাগো, নিজে জেগে অপরকে জাগাও।’ সমাজকে জাগানোর কাজ যারা নীরবে নিভৃতে করে যান, যারা সমাজকে আলোকিত করতে আলোকিত মানুষ তৈরি করেন, তারাই তো শিক্ষক! কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তার শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতার শেষাংশে বলেছিলেন, ‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর’। শিক্ষাগুরুর শির সত্যিই সর্বদা উন্নত, তবে শুধু শির উন্নত হলেই কি সমাজ তথা রাষ্ট্র তার দায়ভার এড়াতে পারে? এ দেশের শিক্ষকরা আদিকাল থেকেই অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। তা থেকে পরিত্রাণ কবে মিলবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন?
স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে শিক্ষকদের যে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি, সেটা নয়, বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এখনো যেসব বৈষম্য থেকে গেছে, সেটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছি। উন্নত বিশ্বকে যদি বাদও ধরা হয়, শুধু দক্ষিণ এশিয়ার গুটিকয়েক দেশের বিবেচনায়ও শিক্ষকদের সম্মানীর তালিকায় আমরা তলানিতে! এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের যদি প্রশ্ন করা হয়, তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বড় অফিসার! কেউ কি ‘শিক্ষক’ হতে চাই, এ কথাটি বলে? সম্ভবত এ রকম সংখ্যাটি অতি নগণ্য, কারণ সবাই আর্থিক নিরাপত্তা চায়, সামাজিক মর্যাদা চায়। আমাদের প্রাথমিক কিংবা বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে যে বেতন দেওয়া হয়, তা কি আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে! কিংবা সামাজিকভাবে তাদের সেই মর্যাদা কি দেওয়া হয়! অবশ্যই না!
বিগত সরকারের আমলে প্রাইমারি শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা হয়। এ ছাড়া নারী-পুরুষ সবার জন্য যোগ্যতা কমপক্ষে স্নাতক পাস নির্ধারণ করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাইমারি শিক্ষকরা তাদের দশম গ্রেডে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করে যাচ্ছেন। আপেক্ষিকভাবে চিন্তা করলে মনে হতে পারে সরকারীকরণ করার পর তারা কেন দশম গ্রেডের জন্য আন্দোলন করছেন। তবে এর যৌক্তিকতা বিবেচনা করতে হবে। বিশেষ করে ২০১৫ সালের সর্বশেষ যে পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছিল, সেখানে চার শ্রেণিতে ২০টি গ্রেড রাখা হয়েছিল। যেখানে নবম গ্রেডকে প্রথম শ্রেণি এবং ১০-১২ গ্রেডকে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৩-২০ গ্রেডকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী হিসেবে রাখা হয়েছে। গ্রেড বিবেচনায় বর্তমানে প্রাথমিকের শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে যোগ দেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থা একজন শিক্ষককে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা দিচ্ছে! এটা কি জাতির জন্য লজ্জাজনক নয়?
তাই রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা তাদের শিক্ষকদের কর্মচারী হিসেবে সামনের দিনগুলোতেও বিবেচনা করবেন কি না! দেশ যখন তার শিক্ষকদের কর্মচারীর মর্যাদা দিচ্ছে, বিনিময়ে দেশ তাদের কাছে কি আশা করতে পারে? সম্ভবত এ বিষয় নিয়ে সে রকম করে ভাবা হয়নি, তবে আমাদের ভাবতে হবে ‘তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী’ হিসেবে মূল্যায়িত হওয়া একজন শিক্ষকের জন্য যেমন মানহানিকর, ঠিক তেমনি হীনম্মন্যতায় ভোগা একজন শিক্ষক কী কখনো তার শিক্ষার্থীদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কি না! এ বিষয় নিয়ে নবগঠিত শিক্ষা কমিশনের কাজ করতে হবে, যদি দশম গ্রেডে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নাও থাকে, তারপরও অন্তত তাদের দ্বিতীয় শ্রেণি কর্মকর্তার (১০-১২ গ্রেড) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, সেটা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোয় দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করার পর দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ মেধাবীরা এই পেশায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাই অন্য বৈষম্যগুলোও বিবেচনা করতে হবে। প্রাইমারি শিক্ষকদের টিফিন ভাতা দেওয়া হয় মাসে ২০০ টাকা, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ করার জন্য কোনো অফিস সহকারী না থাকায়, শিক্ষকদেরই দাপ্তরিক কাজগুলো করতে হয়। এমনকি ছুটির ঘণ্টাটাও শিক্ষকদের বাজাতে হয়! অফিস সহকারী না থাকায় ক্লাসরুম পরিষ্কার রাখার মতো কাজ করারও কেউ থাকে না। প্রোপার স্যানিটেশন আর ক্লাসরুমে ফ্যানের ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত রাখাটা জরুরি। গত কয়েক বছরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রাথমিকে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে, যা চোখে পড়ার মতো! যদি তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা দেওয়া হয়, আশা করা যায় ভবিষ্যতে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে হীনম্মন্যতা ভুগবে না এবং দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ভিত আরো মজবুত হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের এমপিও স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষক কর্মচারীদের অবস্থাও কিন্তু খুব একটা সুবিধাজনক নয়। সরকারি স্কুলের নিয়োগ প্রক্রিয়া আলাদা এবং তুলনামূলক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হলেও বর্তমান সময়ে এমপিও স্কুল-কলেজগুলো এনটিআরসির অধীনে তিনটি ধাপ পার করে তারপর যোগ্যতা বিবেচনায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। অথচ সরকারি স্কুল থেকে এমপিও স্কুলের শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধার মধ্যে বিস্তর ফারাক! এমপিও স্কুল কলেজের শিক্ষকরা শুধু বেসিক বেতন পেয়ে থাকেন। বাসাভাড়া বাবদ তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ থাকে না। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের কি বাসাভাড়া দিতে হয় না? এ ছাড়া ঈদসহ ধর্মীয় উৎসবে বোনাসের ক্ষেত্রে এমপিও স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা বেসিকের ২৫ শতাংশ পেয়ে থাকেন। এই বেসিকের ২৫ শতাংশের যে টাকা তাদের দেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কি উৎসবের আমেজ তাদের বাসায় লাগছে! দিনের পর দিন এই শিক্ষকরা এমন বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন।
গত বছর বেসরকারি শিক্ষকদের আন্দোলনে বিগত সরকারের পক্ষ থেকে বৈষম্য দূরীকরণের আশ্বাস দিলে আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষকরা। তবে এই বৈষম্য দূর না হলে এই আন্দোলন বারবার ফিরে আসবে- এটাই স্বাভাবিক। ঢালাওভাবে যদি জাতীয়করণ করা সম্ভব নাও হয়, অন্তত বেসিকের একটি নির্দিষ্ট অংশ বাসাভাড়া এবং বেসিকের সমান উৎসব বোনাস দিলেও বৈষম্য অনেকটা দূর হবে আশা করা যায়। এ ছাড়া এনটিআরসির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া আরো সহজ করা উচিত, বিশেষ করে নিবন্ধন পাস করে অধিকাংশই বসে থাকে গণবিজ্ঞপ্তির আশায়। আর গণবিজ্ঞপ্তি নির্দিষ্ট কোনো সময়ে হচ্ছে না। যার ফলে কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে। তা ছাড়া যোগদান থেকে শুরু করে বেতন উত্তোলন পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের হয়রানির অভিযোগ আছে শিক্ষকদের। সরকারি স্কুলগুলোয় ট্রান্সফারের সুযোগ থাকলেও এমপিও স্কুল-কলেজে এমন কোনো সুযোগ নেই!
২০১৮ সালে ৩০৩টি কলেজকে জাতীয়করণ করা হয়, তবে প্রতিষ্ঠানগুলোয় বেশ কিছু অসংগতি এবং বৈষম্য রয়েছে বলে অনেক শিক্ষকের মত পাওয়া যায় পত্রপত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়। বিশেষ করে কালক্ষেপণ করে প্রক্রিয়াটি জটিল ও দীর্ঘায়িত করার অভিযোগ আছে। কলেজগুলো সব থেকে বেশি সমস্যায় আছে শিক্ষকসংকট নিয়ে। ২০১৬ সালের পর থেকে চুক্তিবদ্ধ থাকায় নতুন করে কোনো শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া যায়নি। এ ছাড়া অবসরে গিয়েছেন অনেক শিক্ষক। ফলে নতুন করে শূন্য পদও সৃষ্টি হয়েছে, তবে তার বিপরীতে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যার ফলে তীব্র শিক্ষকসংকটে ধুঁকছে প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি প্রক্রিয়াটি দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ পুরোনো, বিশেষ করে আট বছরেও সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন না হওয়াটা বেশ হতাশার। এ ছাড়া গ্রেড অবনমন একটি বড় বৈষম্য তৈরি করেছে, যাতে করে সপ্তম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডে অবনমন, বেসরকারি আমলের থেকে কম বেতন পাওয়া, নবম গ্রেডের প্রদর্শক, লাইব্রেরিয়ান ও শারীরচর্চা শিক্ষকদের দশম গ্রেডে অবনমন, দশম গ্রেডের সহকারী লাইব্রেরিয়ানদের ১৪ গ্রেডে অবনমন ইত্যাদিসহ বেশ কিছু অসংগতি আছে।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের আগস্টে জিও জারির পর থেকে যারা গত ৬ বছরে অবসরে গিয়েছেন, তাদের নিয়েও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। যার ফলে গত ৬ বছরে যারা অবসরে গিয়েছেন, তাদের দিন কাটছে শুধুই হতাশায়। বেসরকারি অবস্থায় অবসরে গেলেও হয়তো এক-দু বছরের মধ্যে অবসরের এককালীন কিছু অর্থ পাওয়া যেত, তবে সরকারি হয়ে যেন উল্টো বিপদে পড়ে গেছেন তারা। এ ছাড়া বেসরকারি আমলের চাকরির সময়কালকে অর্ধেক বিবেচনা করার সিদ্ধান্তও অযৌক্তিক। এর ফলে অবসরে যাওয়া শিক্ষক এবং সিনিয়র শিক্ষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
এসব অসংগতি রেখে শিক্ষাব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। শুধু বাইরে থেকে ডিগ্রি আনলেই তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার রীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ এই মন্ত্রণালয়ের ওপর জাতির অনেক কিছুই নির্ভর করে। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে থাকা এসব বৈষম্য দূর করতে হবে। পাশাপাশি বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোটাও জরুরি। দরকার হলে অপরিকল্পিত যেসব মেগা প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়, সেগুলো বাদ রেখে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষা খাতের অসংগতিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : কলাম লেখক ও ব্যাংক কর্মকর্তা
জনতা ব্যাংক পিএলসি, চৌরাস্তা শাখা, পটুয়াখালী
"