ড. এম জামালউদ্দীন আহমদ
বিশ্লেষণ
প্লাস্টিক দূষণ : কারণ, প্রভাব এবং সমাধান
বাংলাদেশে বিপজ্জনক হারে প্লাস্টিক দূষণ বেড়েই চলছে। এখনই জরুরি ভিত্তিতে এটির নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নতুবা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। ২০১৮ সালের জাতিসংঘ পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করুন- যদি আপনি এটিকে পুনরায় ব্যবহার করতে না পারেন, প্রত্যাখ্যান করুন।’
প্লাস্টিক কী? প্লাস্টিক হলো একটি সিনথেটিক বস্তু যেটি বড় জৈব পলিমার থেকে তৈরি হয়। যেমন- পলিইথাইলিন, পিভিসি, নাইলন ইত্যাদি। প্লাস্টিক অপচনশীল বর্জ্য বলে এটি পরিবেশে ৫০০ থেকে ১ হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।
দূষণের কারণ : বেড়েই চলছে প্লাস্টিক দূষণ। যা মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ বাড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের জলাভূমি, কৃষি ভূমিসহ সাগরের মৎস্য, জলজ উদ্ভিদসহ অন্যান্য সম্পদও হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছি। আমার মতে, সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় প্লাস্টিক পণ্যের জনপ্রিয়তাও বেশি। শুধু খাবারের প্যাকেট বা পানির বোতলই নয়, বর্তমানে আধুনিক জীবনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্লাস্টিকের একবার ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রী, যেমন- প্লেট, গ্লাস, চামচ ও চায়ের কাপ। এ ছাড়া টুথব্রাশ, টেবিল-চেয়ারসহ বিবিধ পণ্যসামগ্রী তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। আর প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়লেও এটি রিসাইকেল ও রি-ইউজের পরিমাণ না বাড়ায় এসব প্লাস্টিকের অধিকাংশই সরাসরি চলে যাচ্ছে পরিবেশে। গত ৫০ বছরে পুরো বিশ্বে মাথাপিছু একটনের বেশি প্লাস্টিকের বিভিন্ন পণ্য উৎপাদিত হয়েছে। যার ৯০ শতাংশের বেশি পৃথিবীর পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি এবং ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে।
প্রভাব : গবেষণায় দেখা গেছে, পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগ জলাশয়ের অতিরিক্ত দূষণকারী কীটনাশক ও শিল্পবর্জ্য শোষণ করে এবং তা জলাশয়ের প্রাণে বড় মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়। তখন ক্ষতিকর পদার্থ মাছ ও অন্যান্য খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে। পলিথিন প্রজনন সিস্টেম ব্যাহত করে, বন্ধ্যত্ব ও ক্যানসারের সৃষ্টি করে। পলিথিনে মোড়ানো গরম খাবার গ্রহণ করলে ক্যানসার ও চর্মরোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। ওভেন প্রুফ প্লাস্টিক কনটেইনারে খাবার গরম করলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে খাবারে ক্যাডমিয়াম, ক্লোমিয়াম, আর্সেনিক ও সিসা মিশে যায়। ফলে ক্যানসারসহ মারাত্মক রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়। এ ব্যাকটেরিয়া থেকে ডায়রিয়া ও আমাশয় ছড়াতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকাসহ প্রত্যেকটি জেলা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশি টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পচনশীল পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ, পরিবেশবান্ধব পাটজাতদ্রব্য, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙা, কাপড়ের ব্যাগ ইত্যাদি বিকল্প থাকা সত্ত্বেও আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার করা হচ্ছে।
সমাধান : ২০০২ সালে বাংলাদেশেই প্রথম একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন নিষিদ্ধ করে, আইনে যা আছে : বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সালের ৯ নম্বর আইন দ্বারা সংশোধিত)-এর ৬ক-এর ৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে সরকার কঠোরভাবে কোনোপ্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ বা এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে এবং শাস্তি ও জরিমানার বিধান রেখেছে। তবু বিগত ১৬ বছরে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই। ২০০২ সালে তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের ওপর জারীকৃত নিষেধাজ্ঞা দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশকে অনুসরণ করে চীন, ভারত, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেদারল্যান্ডস, শ্রীলঙ্কা, মরক্কো, কেনিয়াসহ অনেক দেশ প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নিষ্ক্রিয়তায় বিগত ১৬ বছরে এ-আইনটি সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদারের মতে, প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের চেয়ে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা বেশি জরুরি। প্লাস্টিক দিয়ে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গৃহস্থালি নানা পণ্য তৈরি হচ্ছে, যা ১০ থেকে ২০ বছর ধরে ব্যবহার করা যায়। এগুলো সমস্যা না, সমস্যা যে জিনিসগুলো আমরা ঘণ্টাখানিক ব্যবহার করে পরিবেশে ছেড়ে দিচ্ছি। এটিকে দুষ্প্রাপ্য করতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প খোঁজার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে, প্লাস্টিক নিজেই কাচের জিনিসের বিকল্প হিসেবে এসেছিল। প্লাস্টিকের মতো সহজলভ্য করে পরিবেশবান্ধব পাটজাত দ্রব্য বা পাটের ব্যাগ আনলে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমে যাবে। এ ছাড়া কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙা এবং কাপড়ের ব্যাগ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সাবেক সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রীত্রয় যথাক্রমে ড. হাছান মাহমুদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং মো. শাহাব উদ্দিন বলেছিলেন, একটি প্লাস্টিক কারখানা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করায় কোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় তারা কিছু করতে পারছেন না, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৮৯ সালের বেসেল কনভেনসন অনুসারে বাংলাদেশে পলিথিন/প্লাস্টিক ব্যাগ এবং সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রণীত ‘মাল্টিসেক্টোরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’-এ ২০৩০ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ ভার্জিন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার হ্রাস করা, ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা কাগজেকলমেই লেখা আছে, বাস্তবে বিগত ১৬ বছরেও এর কোনো প্রয়োগ নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটির কার্যকারিতা এখনো দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া প্লাস্টিকবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব 4R (Refuse, Reduce, Reuse and Recycle) নীতি গ্রহণ করে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি দূষণমুক্ত বাংলাদেশ রেখে যেতে হবে।
সমস্ত ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মধ্যে ৪০ শতাংশ মাত্র একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়, যা পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। প্লাস্টিকের সর্বশেষ জিনিসটি ভেঙে শেষ করা যায় না। প্লাস্টিককে পোড়ালে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, যা মারাত্মক বায়ুদূষক। যদি প্লাস্টিক মাটি চাপা দেওয়া হয়, তাতে চারপাশের মাটিকে বিষাক্ত করে তোলে। প্লাস্টিক একটি মারাত্মক পানিদূষক এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহাসাগরদূষক।
রিসাইক্লিং হলো উত্তম পদ্ধতি, যা দিয়ে প্লাস্টিক দূষণ নির্মূল করা যায়। আমার এক ছাত্র (ড. মইন উদ্দীন সরকার) আমেরিকায় একটি নতুন রিসাইক্লিং পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা দিয়ে ১ টন প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে ১৩ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম তেল উৎপাদন করা যায়। অন্য একটি পদ্ধতিতেও রিসাইক্লিং করা যায়, তা হলো Blest Machine ব্যবহার করে ১ টন প্লাস্টিক থেকে ১৬ ব্যারেল পেট্রোলিয়াম তেল পাওয়া যায়, যা আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আপনি একজন পরিবেশবিদ হিসেবে উপযুক্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ায় আপনাকে স্বাগতম। আপনার কাছে আমার আবেদন আপনি ২০০২ সালের ৯ নম্বর আইনের ৬ক-এর ৫ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কঠোরভাবে তা নিষিদ্ধ করুন এবং দেশকে বাঁচান। প্রধান উপদেষ্টা আপনার কাছে আমার আকুল আবেদন আপনি মাদক ও অ্যাসিড সন্ত্রাসের মতো জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দেশকে রক্ষা করুন। আপনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাংলাদেশের নাম বিশ্বে উজ্জ্বল করেছেন, এখন প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করে ২০০২ সালের মতো বাংলাদেশকে দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করুন।
লেখক : পরিবেশবিজ্ঞানী ও উপাচার্য, ফেনী ইউনিভার্সিটি
"