মো. তাহমিদ রহমান
মুক্তমত
সযত্নে লালিত কন্যা আগামীর আলোকিত মা
আজকের কন্যারাই আগামী দিনের জায়া ও জননী। কন্যাশিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাদ্য ও পুষ্টি, আইনি সহায়তা, ন্যায়বিচার, বলপূর্বক বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, সমাজের সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগপ্রাপ্তির লক্ষ্যে প্রতিবারের মতো এবারও ‘কন্যাশিশুর স্বপ্নে গড়ি আগামীর বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য সামনে নিয়ে পালিত হচ্ছে জতীয় কন্যাশিশু দিবস। পৃথিবী জুড়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ ও লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে কানাডা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিবসটি পালনের প্রস্তাব দেয় এবং ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনে দিবসটি পালন করে থাকে। কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য নিরসন এবং তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার আহ্বান জানিয়ে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশ দিবসটি পালন করে আসছে।
বিশ্ব জুড়ে কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নৃশংসতার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সর্বত্রই কন্যাশিশুরা নানাভাবে অবহেলিত। ভালোবাসা, মর্যাদা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সবক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স আঠারো বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কন্যাশিশু যাদের পেছনে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কন্যা-জায়া-জননীর বাইরেও কন্যা-শিশুর বৃহৎ জগৎ রয়েছে। স্বাধীনভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করা ছাড়াও পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। এ জন্য কন্যা-শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ বেড়ে ওঠার সব অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
এই সমাজব্যবস্থা সন্তান হিসেবে এখনো পুত্রদের জরুরি মনে করে। কিন্তু আমাদের উচিত পিতা কিংবা ভ্রাতা হিসেবে নয় মানবিক মেধাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে কন্যাদের ভালোবাসা। একটি পরিবারে নতুন অতিথি হয়ে কন্যাশিশুরা জন্মগ্রহণ করে স্বর্গের পবিত্র ফুল হয়ে অথচ আমাদের সমাজব্যবস্থা কন্যাদের ধারণ করে বোঝা হিসেবে। কন্যাশিশুদের সমাজ অবহেলার চোখে দেখে বলেই আজকে কন্যা দিবস পালন করতে হয়। আমাদের পরিবার ব্যবস্থায় মাতা-পিতার উচিত তাদের কন্যাদের বোঝানো তুমি প্রথমে মানব তারপরে নারী। একজন মানুষের পরিচয় জন্মগতভাবে নয়, তার মূল পরিচয় চিন্তাশক্তি, জ্ঞান, দক্ষতা, সৃষ্টিশীলতা ও যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে। শুধু জন্মগতভাবে শারীরিক কিছু গঠনের জন্য কন্যাশিশুদের অবেলায় অন্যের মুখাপেক্ষী না করে তাদের শেখানো দরকার কীভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। কীভাবে দুঃখকে জয় করতে হয়। কীভাবে জীবনবোধের গভীরতায় প্রবেশ করে স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে হয়।
জীবন বহতা নদীর মতোই চলমান, তাই সমাজব্যবস্থাকে গতিশীল রাখতে হলে আমাদের কন্যাশিশুদের শেখাতে হবে এই বিশ্বব্রহ্মা- তোমাদেরও, সুতরাং নিজেদের মেধা, প্রজ্ঞা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সমাজকে আলোকিত কর। ঠিক যেভাবে আলোকবর্তিকা হয়ে বর্ণিল বিচ্ছুরণ ছড়িয়েছে বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, দেবী চৌধুরানী, নুরজাহান বেগম, ইলা মিত্র, নীলিমা ইব্রাহীম, নভেরা আহমদ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, বাসন্তীদেবী, মাতঙ্গিনী হাজরা ও আইরিন খান। যেভাবে দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের সীমান্তবর্তী অবহেলিত গ্রাম কলসিন্দুরের মেয়েরা। যথাযথ পরিবেশ পেলে একজন কন্যাসন্তান কী করতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পৃথিবী ও পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষায় বড়দের থেকে অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, যার ফলে মাত্র দুই বছরের মধ্যে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্দোলনের দূত হয়ে ওঠে।
দেশের সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে কন্যাশিশুদের অবহেলা না করে সমতা বিধানের নিশ্চয়তা করতে হবে পরিবার থেকে। সমাজের সব স্তরে কন্যাশিশুদের সহিংসতামুক্ত পরিবেশ দিতে হবে। আমাদের মাথায় রাখা দরকার পৃথিবীতে মানবজাতি বিস্তারের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হচ্ছে কন্যাশিশু। তাই কন্যাশিশুদের শিক্ষার আলোয় বিকশিত হওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষায়ও তাদের যুক্ত করতে হবে। উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করতে হবে। আমাদের কন্যাশিশুদের ঠিক সেভাবেই সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা দ্বিধার পাহাড় ভেঙে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। কন্যাশিশুদের শিক্ষার পাশাপাশি ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক দিনবদলের যে সূচনা হয়েছে, সেখানে পুরুষতান্ত্রিকতার বিধিনিষেধ ভেঙে চিন্তা, বোধ ও বুদ্ধিতে বাংলাদেশের কন্যাশিশুরা আলোকবর্তিকা হয়ে উঠুক।
তাই আমাদের কন্যাশিশুদের জন্য মলিনতামুক্ত সুস্থ ও সুন্দর জীবনের অধিকার দিতে হবে। এই বিশ্বকে কন্যাশিশুদের জন্য বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে বৈশ্বিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। কন্যাশিশু সুরক্ষা পেলে সমাজের সব বৈষম্য দূরীভূত হবে। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ, পাচার ও যৌন নির্যাতনের মতো ঘৃণিত অপরাধগুলো কমে যাবে। পৃথিবীর সব নারীই কারো না কারো কন্যা। তাই ভালো থাকুক পৃথিবীর সব কন্যা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব কন্যার মা-বাবারা।
লেখক : প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি)
নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা
"