আব্দুল্লাহ আল মুনাইম

  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাসংকট কাটবে কবে?

শিক্ষা হলো জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় এবং তাকে সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যেসব দক্ষতা প্রয়োজন, সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে দক্ষতা বা জ্ঞান অর্জনই হলো শিক্ষা। বাংলা শিক্ষা শব্দটি এসেছে ‘শাস’ ধাতু থেকে, যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ এডুকেশন এসেছে লাতিন শব্দ এডুকেয়ার বা এডুকাতুম থেকে, যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা।

কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা একজন ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে শিক্ষার সর্বস্তরে নানামুখী সংকটে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। আমাদের দেশ চিরাচরিত যে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত ছিল এবং বিগত দশকগুলোয় যে অগ্রগতির ধারায় এগোচ্ছিল, করোনার কারণে ব্যাপকভাবে তার নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় শিক্ষাব্যবস্থার ধরন ও স্বরূপ বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং ক্রমেই তার আধুনিকায়ন ঘটেছে। কিন্তু করোনার কারণে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে নতুন প্রজন্মের আগামীর স্বপ্নসৌধ নির্মাণের মূলকেন্দ্র শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। করোনাকালীন সময়ের পর শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা অগ্রগতি হলেও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা নানা রকম সংকটে পড়ে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্বিবদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষা খাতে করোনার প্রভাব কাটিয়ে না উঠতেই শুরু হয় ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটে এবং মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। পরে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা যাচ্ছে দেশের সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রশাসনবিহীন। ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রশাসন না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় স্থবির হয়ে পড়েছে। চলছে না কোনো অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম। ক্লাস পরীক্ষায় বসতে পারছে না সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যা তাদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাকে আরো দীর্ঘায়িত করছে।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ১৬৯টি। এর মধ্যে ৫৫টি পাবলিক ও ১১৪টি বেসরকারি। অধিভুক্ত কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীসহ দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭ জন। অধিভুক্ত কলেজ-মাদরাসা ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ২,৯২,২৯৬ জন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৩,৪১,০৯৮ জন। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে ক্রমেই। কারণ হিসেবে দেখা যায়, ভয়াবহ সেশনজট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে। সেশনজট তাদের জন্য একটি আতঙ্কের নাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান পড়াশোনার পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও প্রয়োজনীয় অনেক কিছু এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা তাদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। এ ছাড়া ১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাও কাঙ্ক্ষিত সেমিস্টার শেষ করতে পারেনি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা ২০১৯ সালে বিদ্যালয় ভর্তি হই। তারপর থেকে পাঁচ বছরের অধিক সময় কেটে গেলেও এখনো আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা হয়নি। কবে হবে তাও অনিশ্চিত। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রশাসন কিছুই নেই। দীর্ঘ তিন মাসের বেশি সময় ধরে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ। এতে করে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়তে হচ্ছে। আমরা চাই দ্রুতই এর একটা সমাধান হোক।’

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ রকম সমস্যা খুব একটা দেখা যায় না। সেশনজট দূর করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার জায়গাটা দুর্বল বিধায় সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়েছে।

শুধু সেশনজট না, নানামুখী সমস্যার জর্জরিত দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ে নেই পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা, গবেষণা করার সুবিধাসহ একজন শিক্ষার্থী কীভাবে দক্ষ হবে তার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে চাকরির বাজারে সব সময় পিছিয়ে থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি এবং যৌন সহিংসতা শিক্ষাসংকট তৈরি করার অন্যতম কারণ। এসব কারণে কিছুদিন পরপর সংঘর্ষ, হতাহত হওয়ার ঘটনা, নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং যৌন সহিংসতার খবর ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু যথাযথ বিচারের নজির কম, তাই যারা সংঘাত ও সহিংসতার শিকার, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে খুব অসহায়বোধ করে।

দেশের এই বর্তমান শিক্ষাসংকট নিরসনে খুব দ্রুতই কাজ করতে হবে। তা ছাড়া দেশের শিক্ষা খাত ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। দেশের বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সৎ, যোগ্য ও শিক্ষার্থীবান্ধব ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করা। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ল্যাব ও গবেষণার সুবিধা বাড়ানো। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে করে খুব দ্রুতই দেশের এই নানামুখী সংকট নিরসন করা যায়। শিক্ষার্থীরা তাদের ক্লাস পরীক্ষায় ফিরে যেতে চায়। তাই শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস নিশ্চিত করে খুব দ্রুতই ক্লাস পরীক্ষা শুরু করা হবে বলে আমরা আশাবাদী। আমরা জানি, চলমান এই শিক্ষার সংকট এক দিনে দূর হবে না, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ যদি সংকল্পবদ্ধ হয় শিক্ষার সংকট দূর করতে, তাহলে অনেক দূরই এগিয়ে যাওয়া যাবে। কারণ শিক্ষা হচ্ছে বিনিয়োগের শ্রেষ্ঠ জায়গা, যার সুফল পুরো দেশ পায়।

লেখক : শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close