ডা. ফয়সাল আহমেদ
দৃষ্টিপাত
হার্টের যত্নে মানুষের করণীয়
হার্ট বা হৃৎপিণ্ড মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হার্ট প্রতিনিয়ত রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে ঠিকঠাকমতো কাজ করতে সাহায্য করে থাকে এবং রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে শরীরের প্রতিটি কোষে পুষ্টি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পৌঁছে দিয়ে থাকে। যেকোনো শিশুর গর্ভাবস্থায় হার্ট গঠিত হয় এবং হার্টের কার্যক্রম শুরু হয়, গর্ভধারণের ২১ দিন পর থেকেই স্পন্দনের মাধ্যমে প্রাণের সঞ্চার হয় এবং হার্টের কার্যক্রম শুরু হয়। মানুষ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর জীবনসায়াহ্নে এসে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার মাধ্যমে হার্ট তার কার্যক্রম শেষ করে এবং মানবজীবনের সমাপ্তি ঘটে। তারপর মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
প্রাচীন মিসরীয় ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে জানা যায়, শস্য ও ফসলের দেবতা ওসিরিস পাতালপুরীতে থেকে মৃত ব্যক্তিদের পাপ ও পুণ্য জানার জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। কোনো মৃত ব্যক্তির হার্ট বা হৃৎপিণ্ড একটি দাঁড়িপাল্লায় রাখতেন এবং দাঁড়িপাল্লার অপর প্রান্তে একটি হালকা পালক রাখতেন। যদি কোনো মৃত ব্যক্তির হার্টের ওজন পালক সমান হতো, তাহলে তাকে পুণ্যবান মনে করা হতো। আর যাদের হার্ট বা হৃৎপিণ্ড সেই পালক অপেক্ষা ভারী হতো, তখন সেই মৃত ব্যক্তিকে পাপী বলে মনে করা হতো। আর এই কলুষিত হৃদয়ের ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো। একসময় মিসরের মৃত ব্যক্তিদের মরদেহ মমি তৈরি করার প্রচলন ছিল। মমি তৈরির কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছিল। তারা মৃতদেহ সংরক্ষণের লক্ষ্যে মৃত মানুষটির বুক থেকে পেট পর্যন্ত চিরে দেহের অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বের করে ফেলতেন। কিন্তু মৃত ব্যক্তির দেহের হার্ট বের করতেন না। হার্টকে বুকের মাঝেই যত্নসহকারে রেখে দিতেন।
মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল, মানুষের আবেগ, অনুভূতি, আনন্দ ও দুঃখ হার্টের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যখন আমরা আমাদের কোনো স্বজনের মৃত্যুর খবর শুনি, তখন আমাদের হার্ট বা হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে। আবার যখন আমরা আনন্দের বা খুশির খবর শুনি, তখনো আমাদের হার্টে বা সারা দেহে এক ধরনের শিহরণ অনুভূত হয়। তাই মানুষের হার্ট বা হৃদয়ের আবেগ অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে ২০০০ সালে নির্মিত হয়েছে বলিউডের বিখ্যাত ছবি ‘ধ্যাড়কান’- এর অর্থ হলো হৃদয়ের স্পন্দন। প্রতিটি মানুষের হার্ট ভালো রাখতে কিছু কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ব্যায়াম করা বা হাঁটাচলা করলে হার্ট ভালো থাকে। মানুষ যখন হাঁটাচলা করে, তখন হার্টে নতুন নতুন রক্তনালি তৈরি হয়। হার্টের এই প্রক্রিয়াকে বলে এনজিওজেনোসিস। মানুষ যখন তার পছন্দের মানুষের কাছে থাকে, তখন মস্তিষ্ক থেকে Feel Good হরমোন এন্ডরফিনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, তখন আমাদের হৃৎপিণ্ড সুন্দরভাবে কাজ করে। আর এর ফলে হৃদয়ে ভালো লাগা তৈরি হয়। এ সময় শরীরে আরো একটি হরমোন বৃদ্ধি পায়, তার নাম হলো প্রোল্যাকটিন। প্রোল্যাকটিন এমন একটি হরমোন, যা মানুষকে নমনীয় আচরণ করতে সাহায্য করে। যে কারণে পছন্দের ব্যক্তির সঙ্গে মানুষ মধুর কণ্ঠে কথা বলে।
পক্ষান্তরে মানুষ যখন রাগান্বিত অবস্থায় থাকে, তখন মস্তিষ্ক থেকে অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। তখন মানুষ উচ্চ স্বরে কথা বলে। এ জন্য মানুষের রাগ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। রাগ মানুষের হার্টের ক্ষতি করে। সামুদ্রিক মাছ খাওয়া হার্টের জন্য অনেক উপকার। সামুদ্রিক মাছের ওমেগাও হার্টের জন্য ভালো। ধূমপানের অভ্যাস হার্টের চরম ক্ষতি করে। দীর্ঘদিনের ধূমপানের অভ্যাস হার্টের ধমনি সংকুচিত করে, যা পরে উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করে। তাই মানুষের ধূমপান পরিহার করা উত্তম। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস হার্টের ক্ষতি করে থাকে। তাই এসব রোগ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। পরিমিত ঘুম হার্টের জন্য বেশ উপকার। হার্টকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিদিন একটি মানুষকে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। মেয়েদের হার্ট ছেলেদের তুলনায় দ্রুত স্পন্দিত হয়। তাই মেয়েদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। ছেলেদের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে চল্লিশ বছরের পর থেকে দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গের কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। সে ক্ষেত্রে হার্টের কর্মক্ষমতাও কমতে থাকে। তবুও মানুষের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হার্ট তার স্পন্দনের মাধ্যমে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু মানুষের জীবনসায়াহ্নে এসে হার্টের সংকুচন ও প্রসারণের ক্ষমতা থাকে না। হার্টের এই অবস্থাকে বলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। হৃদযন্ত্র যখন তার নিজন্ব সংকোচন ও প্রসারণ বন্ধ করে দেয়, তখন দেহ ও মনে অবর্ণনীয় ও অব্যক্ত অনুভূতি তৈরি হয়। অর্থাৎ যার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, একমাত্র তিনিই জানেন এটার অনুভূতি কেমন। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট অনুভূতি মাত্র কয়েক মিনিট চলে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট অবস্থায় মানুষের শরীরের অন্য অঙ্গসমূহও কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তখন মস্তিষ্কে সমস্ত অঙ্গসমূহকে আবার আগের মতো কাজ করার জন্য এক ধরনের সংকেত দেয়। কিন্তু অঙ্গসমূহ মস্তিষ্কের এই সংকেত আর গ্রহণ করে না।
এরপর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়া ব্যক্তির সমস্ত অনুভূতি অন্ধকারে হারিয়ে যায় এবং মৃত্যুবরণ করে। হার্ট মানব শরীরের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হার্ট যদি প্রতি মিনিটে ৬০ বারের কম বিট করে, তখন এই অবস্থাকে বলে ব্র্যাডিকার্ডিয়া এবং হার্ট যদি প্রতি মিনিটে ১০০ বার বা তারও বেশি বিট দেয় তখন তাকে ট্যাকিকার্ডিয়া বলে। এই দুই অবস্থা হার্টের ক্ষতি সম্পন্ন করে থাকে। মানুষের হার্টে গুরুতর সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে হওয়ার আগে কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ জন্য হার্টে এনজিনা বা বুকে ব্যথা হওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাই হার্টের যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে বা সৃষ্টি হলে অতিদ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
লেখক : এমবিবিএস, সিসিডি (বারডেম)
পিজিটি (মেডিসিন, বক্ষব্যাধি এবং কার্ডিওলজি), ইডিসি (বারডেম), ফেলোশিপ ইন গ্যাস্ট্রো এন্টেরোলজি (ইন্ডিয়া), (রেজিস্ট্রার মেডিসিন বিভাগ), জেড এইচ সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
"