শফিকুল ইসলাম খোকন
বিশ্ব নদী দিবস
নদী হত্যা গণহত্যার শামিল
নদী... শব্দটির সঙ্গে আমরা অতি পরিচিত। বাংলার বিচিত্র ভূপ্রকৃতিতে নদীর দান অপরিসীম। প্রধানত নদীকে কেন্দ্র করেই মানুষের বসতি। শহর, নগর, বন্দর পৃথিবীর সব সভ্যতার সূচনা। মানব শরীরে সচল রক্তশিরার মতো নদীও এ দেশের প্রাণ। মানুষের যেমন প্রাণ আছে, নদীরও তেমন প্রাণ আছে। নদী জীবন্ত, নদী জীবন্ত সত্তা। নদীর কাছে মানবসভ্যতার ঋণ অপরিসীম। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই জীবন্ত প্রাণ নিয়ে রয়েছে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, সংগ্রামে নদীর উপস্থিতি নিরবচ্ছিন্ন। আছে নদীকেন্দ্রিক পরিচয়ের প্রাধান্য, রাজনীতির স্লোগানও ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা/তোমার আমার ঠিকানা’। স্বাধীনতার যুদ্ধেও রয়েছে নদীর অবদান, নদী নিয়ে রয়েছে কতশত গান ও কবিতা। এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না।
আজ সেই নদী নিয়ে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, গান আর আমাদের মাঝে নেই। নদীর অবদানও আমরা ভুলে গেছি। কি অকৃতজ্ঞ আমরা; যে নদী দিয়েছে আমাদের সভ্যতা, যে নদীর মাঝে রয়েছে আমাদের জীবিকা, অপার সম্ভাবনা। আজ সেই নদীই হারিয়ে যাচ্ছে, নদী কাঁদছে, নদীর কান্না কেউ শুনতে পায় না বা শুনতে চায়ও না। বাংলাদেশ শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলেই মাতৃক শব্দটি এসে যায়। বলা হয়ে থাকে নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস পালন করতে শুরু করে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ দিবসটি অনুসমর্থন করে। নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন করে আসছে। নদীকে ঘিরে দেশে কয়েকটি দিবস পালিত হচ্ছে। এরপরও নদী সুরক্ষায় কোনো সুফল মিলছে না। সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব, সমুদ্র, প্রাকৃতিক জলাধার, বন (ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যতিরেকে), পাহাড়- সবকিছুর মালিক হচ্ছে রাষ্ট্র, মানে জনগণ। সুতরাং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষার দায়িত্বও তাদের। কিন্তু সেই জনগণেরই একটি অংশ যখন খাল, নদী, জলাশয়, পুকুর ভরাট করে; দখল করে; দূষণে বিপন্ন করে, তখন সংবিধান প্রদত্ত এই মালিকানাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয় কি না। তখন এটি প্রমাণিত হয় যে সংবিধান যাদের রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই জনগণ আসলে ক্ষমতা গ্রহণে রাজি নয় কিংবা তারা এই মালিকানা চায় না। চায় না বলেই সে তার মাকে বিপন্ন করে, নদীকে ধ্বংস করে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত ‘রামসার কনভেনশন ১৯৭১’ এবং ‘রিও কনভেনশন ১৯৯২’ স্বাক্ষর করায় ভূমি ও জলজ পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ কনভেনশন দুটির প্রথমটি জলজ পাখির আবাস সংরক্ষণ-সংক্রান্ত, যা নদী ও জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষার ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়টি ভূমি ও জলের সব প্রজাতির উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ-সংক্রান্ত, যা একই লক্ষ্যে অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুন্দরবন এলাকা ‘রামসার সাইট’ হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। হাকালুকি হাওর এবং সুন্দরবনকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা’ ঘোষণা করায় ওই দুই এলাকার নদী ও জলাভূমিগুলো সংরক্ষণের বেলায় সরকারি দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু এখনই আমাদের দেশের আরো অনেক জলাভূমিকে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে এবং ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
সারা দেশেই আগ্রাসী থাবায় নদীগুলো বিপর্যস্ত। যেকোনো নদীর পাড়ে চোখ মেলে তাকালেই দখলবাজির চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক নদ-নদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে। অনেক নদী ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে। দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে হয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটারের মতো। কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই এটা হুমকিস্বরূপ। নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো, একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদাধিকারীরা নানা কথা বলে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশেও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। ২০১৯ সালে, ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট একটি রায়ে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা (লিভিং এনটিটি)’ বলে আদেশ জারি করেছে। এর অর্থ মানুষের মতো নদীরও সুস্থ-সুন্দর থাকার অধিকার রয়েছে। দখল-দূষণ ভরাটের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে রয়েছে আইনি অধিকার। এর আগে বিশ্বব্যাপী এ ধারণার সূচনা হয়েছে কলম্বিয়া থেকে ২০১৭ সালে। সোনা আর কয়লাখনির কারণে নদী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশটির সাংবিধানিক আদালত ‘রিয়ো এট্রাটো’ নামক একটি নদীকে এ অধিকার দেয়। এ পরিস্থিতি থেকে নদীটিকে রক্ষার জন্যই আদালত একে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করে। শুধু তাই নয়, নিউজিল্যান্ডের একটি নদীকে খুবই পবিত্র মনে করে এবং সেটিকেও জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজ্য আদালত থেকে নর্মদা নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, কারণ নদীটি খাওয়ার পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চলতি বছরের ২৫ ও ২৬ মে ঢাকার ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে দুদিনের জাতীয় নদী সম্মেলন হয়েছে। ওই সম্মেলনে বেলার নির্বাহী (বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা) সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং এএলআরডির নির্বাহী সামছুল হুদার আমন্ত্রণে আমিও ছিলাম। সারা দেশ থেকে পরিবেশবিদ, জলবায়ু যোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন। বেলার দেওয়া তথ্যানুযায়ী দেশের ২২৯টি নদী সংকটাপন্ন। এসব নদী এখনই দখল ও দূষণমুক্ত করা যাবে না। তবে সরকার ও সবাই মিলে চাইলে ৬৪টি জেলার একটি করে নদীকে দুই বছরের মধ্যে দখল ও দূষণমুক্ত করা সম্ভব। সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নদী সংকটাপন্ন রংপুর বিভাগে, ৪৩টি। তা ছাড়া সিলেটের ৪২টি, খুলনায় ৩৭টি, বরিশালে ৩০টি, ঢাকায় ২৮টি, রাজশাহীতে ১৯টি, চট্টগ্রামে ১৭টি ও ময়মনসিংহে ১৩টি নদী সংকটাপন্ন। আমিও ওই সেমিনারে নদী রক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশামালাও তুলে ধরেছিলাম। জাতীয় নদী সম্মেলন শেষে পরিবেশ ও জলাবায়ু বিশেষজ্ঞ শরীফ জামিল ভাইয়ের আমন্ত্রণে সিরডাপ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে ‘উপকূলের কৃষি ও মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায়ও ছিলাম। সেখানে উপকূলের কৃষি ও মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে আলোচনার শীর্ষে ছিল নদী দখল, নদীদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে শুধু যে নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে তা নয়, মৎস্য ও কৃষিসম্পদও হুমকির মুখে। আমাদের সবার একই কথা নদীকে নদীর মতো চলতে দিতে হবে, দখলমুক্ত করতে হবে, দূষণমুক্ত করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, একাধিক জীবন্ত প্রাণীকে হত্যা করলে যেমন গণহত্যার শামিল, তেমনি নদীকে হত্যা করাও গণহত্যার শামিল। আসুন নিজেদের জন্য, জীবিকার জন্য, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য, নদীমাতৃক দেশের ঐতিহ্য ফিরে আনার জন্য সম্মিলিতভাবে নদী রক্ষায় এগিয়ে আসি।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলাম লেখক
"