জলবায়ু পদক্ষেপে বৈশি^ক কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন
নিট-জিরো অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলে শূন্য কার্বন নিঃসরণ করার ধারণাটি ২০০০ সালে গবেষণার মাধ্যমে এসেছে। তখনকার গবেষণায় দেখা যায় কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বায়ুমণ্ডল, মহাসাগর এবং কার্বন চক্রে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই গবেষণায় এটি পাওয়া যায় যে, নিঃসরণ নিট-জিরোতে আনতে না পারলে বৈশি^ক উষ্ণায়ন থামানো সম্ভব হবে না। প্যারিস চুক্তিতে নিট-জিরো অর্জনের লক্ষ্যকে ভিত্তি হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মানুষের সৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন এবং প্রাকৃতিকভাবে গ্যাস শোষণের মধ্যে একটি ভারসাম্য অর্জন করতে হবে।
২০১৮ সালে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ‘১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বৈশি^ক উষ্ণায়ন’ বিষয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর থেকে ‘নিট-জিরো’ শব্দটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবসৃষ্ট কার্বন নিঃসরণ নিট-জিরোতে নিয়ে আসা এবং বাকি গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাব কমানো বহু দশকের মধ্যে বৈশি^ক উষ্ণায়ন রোধ করবে। নিট-জিরো নিঃসরণের ধারণাটিকে প্রায়ই ‘বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব স্থিতিশীল করা’-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। দ্বিতীয় ধারণাটি ১৯৯২ সালের রিও কনভেনশন থেকে এসেছে। এই দুটি ধারণা এক নয়। কেননা কার্বন চক্র প্রতিনিয়ত একটা ক্ষুদ্র অংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেয়, যা মানুষের কার্যকলাপের ফলে পূর্বে নির্গত হয়েছিল। কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে এবং বনায়ন, কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজের মতো প্রক্রিয়া ব্যবহার করে পরিবেশে কার্বন অপসারণ করে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। সহজ কথায়, কার্বন নিরপেক্ষতা বলতে বোঝায় বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের পরিমাণ কমিয়ে এবং অপসারণ করে শূন্য স্তরে নিয়ে আসা। নেট জিরো বলতে বোঝায় বায়ুমণ্ডলে নির্গত কার্বনের পরিমাণ এবং অপসারিত কার্বনের পরিমাণ সমান হওয়া। অন্য কথায়, যত কার্বনের নির্গত হবে, ঠিক ততটাই কার্বনের অপসারণ করা হবে, যার ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণে কোনো পরিবর্তন হবে না।
কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং বৈশি^ক তাপমাত্রার বিপজ্জনক বৃদ্ধি এড়াতে একটি যথাযথ উপায় বের করা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে ২০৫০ সালের একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে দেশগুলো এমন পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করবে, যা বন, ফসল, মাটি এবং ‘কার্বন ক্যাপচার’ প্রযুক্তি দ্বারা শোষিত হতে পারে। তাদের পাশাপাশি, চীন এবং সৌদি আরব ২০৬০ সালের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, বাস্তব পদক্ষেপ ছাড়া এগুলো মূলত অর্থহীন। নিট-শূন্য কার্বন নিঃসরণ ও চরম সম্পদ বৈষম্য দূরীকরণের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জলবায়ু পদক্ষেপের জন্য বৈশি^ক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত বুধবার নিউইয়র্ক টাইমস আয়োজিত ‘ক্লাইমেট ফরোয়ার্ড’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।
সত্যিকার অর্থেই কি পরিবেশ দূষণকে আমরা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে পারব? এর জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অবশ্যই দূষণ দূর করাকে কেন্দ্র করে নিতে হবে। এ ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো উল্লেখযোগ্য পন্থা নেই। শুধু বিশ্ব নেতৃত্ব এবং মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী কার্বন নির্গমন রোধ পরিকল্পনাই আমাদের এ সমস্যা থেকে টেনে তুলতে পারে।
"