ফারজানা ইয়াছমিন মিমি
মুক্তমত
ফেমিনিজম : সমাজের সবার মুক্তির আন্দোলন
ফেমিনিজম বা নারীবাদ হলো একটি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন এবং মতাদর্শ, যার লক্ষ্য হলো লিঙ্গভিত্তিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা। সহজ কথায়, ফেমিনিজম হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান অধিকার, সুযোগ এবং সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা। ১৮৩৭ খ্রি. ফরাসি দার্শনিক ও ইউটোপীয় সমাজবাদী চার্লস ফুরিয়ে প্রথম ‘ফেমিনিজম’ শব্দটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ‘নারীবাদ’ (feminism) এবং ‘নারীবাদী’ (feminist) শব্দ দুটি ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭২-এ, যুক্তরাজ্যে ১৮৯০-এ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১০-এ।
প্রথম দিকে নারীরা মূলত রাজনৈতিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছিল। মতপ্রদানের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার এবং শিক্ষার অধিকার ছিল তাদের প্রধান দাবি। পরে নারীরা ব্যক্তিগত জীবনে সমতা, কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ, প্রজনন স্বাধীনতা এবং যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেমিনিজম আরো বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। এখানে জাতি, বর্ণ, বয়স, শ্রেণি, যৌনতা এবং অভিবাসীদের মতো বিভিন্ন পরিচয়ের ভিত্তিতে অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা হয়।
বাংলাদেশেও ফেমিনিজমের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের আমলেই নারীরা শিক্ষা এবং সামাজিক পরিবর্তনের দাবি তুলেছিল। স্বাধীনতার পর নারীদের অধিকারের জন্য আরো ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু নারীবাদ বা এর চর্চাকে আসলে বাংলাদেশে কখনোই ইতিবাচকভাবে দেখা হয়নি। বাংলাদেশে অনেকের মধ্যে নারীবাদ এবং নারীবাদের চর্চাকারীদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন ফেমিনিজম পরিবারকে ভেঙে দেয়, নারীদের পুরুষদের চেয়ে উচ্চতর মনে করে। অনেকেই একে পুরুষ বিদ্বেষ বলে মনে করে থাকেন। এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়, ফেমিনিস্টরা আসলে পুরুষতান্ত্রিকতার বিপক্ষে নয় বরং পুরুষদের বিপক্ষ হিসেবে দেখে। কিছুদিন আগে, ফেসবুকে ডমিস্টিক ভাওইলেন্স নিয়ে আমার করা এক পোস্টে এক লোক আমাকে ফেমিনিস্ট বলে কমেন্ট করে এবং বলে সে ফেমিনিস্টদের সম্মান করে না। যদিও আমি নিজেকে কখনো ফেমিনিস্ট বলে দবি করিনি। কিন্তু বিষয়টি আমাকে খুব ভাবায় যে আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোক কেন ফেমিনিস্টদের নেতিবাচক চোখে দেখে। ফেমিনিজম মানে শুধু নারীদের অধিকারের জন্য লড়াই করা নয়, বরং সমাজের সবার জন্য সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তারপরও সমাজের মানুষের ফেমিনিজম নিয়ে নেতিবাচক ধারণার কারণ হতে পারে ফেমিনিজম নিয়ে তাদের স্বল্পজ্ঞান। যাই হোক, যেহেতু আমি সমাজের সবার জন্য সমতা ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী সেহেতু নিজেকে আজ থেকে ফেমিনিস্ট দাবি করতেই পারি।
অনেকেই পুরুষকে পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে এক করে ফেলে। পুরুষ আর পুরুষতন্ত্র এক নয়। পুরুষ মানেই যেমন পুরুষতান্ত্রিকতা নয়, তেমনি নারীবাদ মানেই পুরুষ বিরোধিতা নয়। ফেমিনিজম বা নারীবাদ মানে শুধু নারীদের অধিকারের জন্য লড়াই করা নয়, বরং সমাজের সবার জন্য সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। অনেকে মনে করে শুধু নারীরা হবে নারীবাদী। এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়, পুরুষরাও নারীবাদী হতে পারে।
অনেকেই ধারণা করে নারীরাই শুধু পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়, কিন্তু আসলে তা নয়। পুরুষরাও পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়। সাধারণত আমরা পুরুষতন্ত্রকে নারীদের ওপর নিপীড়নের একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখি। কিন্তু দেখা যায় যে পুরুষরাও এই ব্যবস্থার শিকার। পুরুষতন্ত্র পুরুষদের জন্যও নির্দিষ্ট ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়। পুরুষতন্ত্রের মতে পুরুষদের সব সময় শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য এবং আবেগহীন হতে হবে। পুরুষতন্ত্রে পুরষদের আবেগ প্রকাশে বাধা দেয়। পুরুষদের বোঝানো হয় তাদের সব সময় সফল হতে হবে, অর্থ উপার্জন করতে হবে এবং পরিবারের ভরণপোষণ করতে হবে। এই ধরনের সামাজিক চাপ পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক পুরুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হন, কিন্তু তারা সেটি বলে না পৌরুষদীপ্ততার কারণে। যদি কেউ শেয়ার করেন তাহলে সমাজের চোখে তিনি দুর্বল পুরুষ। তাকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের হাসিঠাট্টা করা হয়। তাকে নানাভাবে বুলিয়িং করা হয়। পিতৃতন্ত্র যে শুধু নারীকেই থেকে বঞ্চিত করেছে তা নয়, পুরুষকেও তার মানুষ হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
ফেমিনিজম লিঙ্গের ভূমিকা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই একটি সীমিত এবং স্টেরিওটাইপিক ভূমিকার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা মনে করে, পুরুষদের শক্তিশালী, আবেগহীন এবং সফল হতে হবে এই ধারণাটি অবাস্তব এবং ক্ষতিকর। নারীবাদীরা এই ধারণাকে ভেঙে নতুন এক ধরনের লিঙ্গ ভূমিকা গড়ে তুলতে চায়, যেখানে পুরুষ ও নারী উভয়ই তাদের আবেগ প্রকাশ করতে পারবে, বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে পারবে এবং সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পাবে।
ফেমিনিজম শুধু নারীদের জন্য নয়, সমাজের সবার জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে। এটি পুরুষতন্ত্রের তৈরি করা পুরুষদের ভূমিকা থেকে তাদের মুক্তি দেয়। তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার আদায়েও কাজ করে ফেমিনিজম। ফেমিনিজম বা নারীবাদ মানে শুধু নারীদের অধিকারের জন্য লড়াই করা নয়, বরং সমাজের সবার জন্য সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
"