ড. মিহির কুমার রায়

  ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ

আমাদের এই শ্রমঘন সমাজে জুতসই একটি কাজ খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিজের যোগ্যতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে পছন্দমতো চাকরি করা- মানুষের সারাজীবনের আকাঙ্ক্ষা। শিক্ষাজীবন থেকেই আমাদের সমাজের মানুষ ব্যস্ত থাকে ভবিষ্যতে কী কাজ করবে, কোন ধরনের চাকরি করবে তা নিয়ে। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি থাকে সরকারি কোনো উচ্চপদে চাকরির জন্য। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা করপোরেশনে চাকরি করার ক্ষেত্রে অধিকতর মেধাবীরা প্রস্তুতি নিতে থাকে শিক্ষাজীবন থেকেই। এখানে দোষের কিছু নেই। নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলে কেউ যদি যথাযোগ্য চাকরি পায়, তখন সে তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে কর্মক্ষেত্রে। এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে একনায়কত্ব, কাজ সৃষ্টিতে স্থবিরতা, কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক দৈব-বিত্তায়ন যুব ছাত্রসমাজের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে, যা থেকেই কোটা আন্দোলন ও সরকারের পটপরিবর্তন। এখন যুবক আন্দোলন বেষ্টিত কেয়ারটেকারের ওপর সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা অনেক এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই প্রত্যাশা পূরণ সহজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ আগে পরিবেশ সৃষ্টি, তারপর ইলেকশন, তারপর গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ, যা সময়সাপেক্ষ, যা সরকারের আলাপ-আলোচনা থেকে অনুধাবন করা যায়।

এর আগে ঘটে যাওয়া আন্দোলন এবং তার দমন ঘিরে অর্থনীতিতে বিপুল ক্ষতি হয়েছে। এ সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানিকারকদের। কাজ হারিয়েছেন ফ্রিল্যান্সাররা, সঙ্গে গ্রাহকও এবং তার সঙ্গে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে যারা দিন আনে দিন খায় তারা। এর বাইরে যারা ধনী, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; বিশেষ করে যারা উদ্যোক্তা, তাদের কলকারখানা বন্ধ থাকার পরও বেতন দিতে হবে। সাপ্লাই চেইনে চরম ব্যাঘাত ঘটেছে। এর চ্যালেঞ্জ এখন বহুমুখী। টেকসই সমাধান না হলে আবার কী হয়, সে চিন্তা তো সবার আছেই। বিশ্বে আমাদের যে শান্তিপূর্ণ ও ব্যবসায়িক পরিবেশের ইমেজ ছিল, সেটি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

নতুন অর্থবছরে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হবে সরকাকে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা, ডলারসংকট মোকাবিলা করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো। দেশে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এসব খাতে লক্ষ্য অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং, যা বর্তমান তদারকি সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। এসবের পাশাপাশি আরো কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আইএমএফের শর্তের বাস্তবায়ন এবং এর প্রভাব মোকাবিলা। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে আস্থার সঞ্চার করা, রেমিট্যান্সপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক অবস্থায় আনা। এ ছাড়া টাকা পাচার রোধ এবং হুন্ডির প্রভাব কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা, বিনিয়োগ হ্রাস, ডলারসংকট ও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিও কম। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণও কম হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। এতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে বিনিয়োগও। রাজস্ব আয় না বাড়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোয় তারল্যসংকট থাকায় চাহিদা অনুযায়ী সরকারকে ঋণের জোগানও দিতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায়ও ঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারের আর্থিক সংকট প্রকট হচ্ছে।

অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত আরো যে বড় একটি জঞ্জাল সাফ করায় অন্তর্বর্তী সরকারকে হাত দিতে হবে তা হলো, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং ঘটে যাওয়া দুর্নীতির বিচার। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর এখনই সময়, কারণ বিরল ও অভূতপূর্ব ঘটনা অর্থনীতির জগতে। তিনজন প্রধানই অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান, অর্থ উপদেষ্টা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। তারা তিনজনই অর্থনীতির ছাত্র, প্রতিষ্ঠিত গবেষক। এটা আগে কখনো বাংলাদেশে ঘটেনি। সরকারপ্রধানের কথা বাদ দিলাম, এর আগে অর্থমন্ত্রীদেরও সম্ভবত একজন বাদে আর কেউ অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। গভর্নর পদে আমলাদেরই প্রাধান্য ছিল, যদিও একবার বা দুবার ব্যাংকাররা গভর্নর হয়েছেন, সম্ভবত দুবার অর্থনীতিবিদ গভর্নর হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, অর্থনীতি আজ অর্থনীতিবিদদের হাতে। যারা এত দিন বাইরে থেকে কথা বলতেন, পরামর্শ দিতেন, উপদেশ দিতেন, সমালোচনা করতেন, তারাই আজ দেশের অর্থনীতির মূল কর্তা। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তাদের আর পরামর্শ দিতে হবে না কাউকে। তারা অর্থনীতি, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যার কথা জানেন। সমাধানের পথও তাদের জানা। দ্বিতীয়ত, তিনজনই মিডিয়ার পরিচিত মুখ। তাদের আরো সুবিধা এই যে, তারা আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা, প্রতিষ্ঠান, বিদেশি সরকারগুলোর কাছেও পরিচিতজন। সবচেয়ে বড় কথা, এ মুহূর্তে তাদের শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা। অতএব দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে প্রচলিত রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন তাদের হতে হবে না। এ এক বিশাল সুযোগ, সম্ভাবনা ভালো কাজ করার। এতগুলো সুবিধায় বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক নেতৃত্বের কাছে জাতির আশা অনেক বেশি। বাকিটা ভবিষ্যৎ বলবে। সেটা পরের কথা। এই মুহূর্তের কাজ হিসেবে নতুন নিযুক্ত অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি কৃষকের সার, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারি আমদানিতে গুরুত্ব দেবেন। যুগান্তরে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, তিনি অর্থনৈতিক খাত সচল করতে এবং অস্থিরতা কমিয়ে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চান। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসবেন। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একার পক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, যদিও এটাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছেন; তিনি সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক ভালো করার তুলনায় মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে চান। মোটা দাগে এই হচ্ছে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল যতই দীর্ঘায়িত হোক না কেন, যেহেতু এটি কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, সেহেতু শেষ পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা তাদের রয়েছে। কাজেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেই নির্বাচনে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি। এ জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো দেশে গণতান্ত্রিক বিধিবিধান ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, যা বিগত এক-দেড় দশকে একেবারে ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রহীনতা ও দুর্নীতি দেশে যে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে; ধর্মাধর্মের বিভেদের কারণে যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি হয়েছে, তার নিরসনও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি। এসব কাজ রাজনৈতিক সরকার করার মতো পরিবেশ দেশে কবে তৈরি হবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কাজেই এর যতটা করা সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই করতে হবে। সে জন্য অবশ্যই তাদের সময় প্রয়োজন। কারণ এর সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত।

তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের জন্য তাদের এ আন্দোলন থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। যারা এ আন্দোলনে সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করেন, তারা যথার্থ অর্থেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হয়েছেন। কখনোই আবেগতাড়িত হননি। তবে তাদের এ নেতৃত্ব প্রচেষ্টা এখানেই থেমে থাকা উচিত হবে না। তারা ইচ্ছা করলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর স্বার্থে ‘সাধারণ ছাত্র ফোরাম’ নামে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমি এটাই বলব, তারা যেন কোনো প্রলোভনের কাছে নতিস্বীকার না করেন। পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে- এটি একটি সফল সামাজিক আন্দোলন, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পরিবার থেকে ছাত্ররা এর সঙ্গে সংযুক্ত হন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারের কোটা নীতির সংস্কার। এ অর্থে আন্দোলনটির রাজনৈতিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। তাই অন্তর্বর্তী তদারকি সরকারকে এই বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে তাদের মেয়াদকালে।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close