মোতাহার হোসেন
বিশ্লেষণ
রেলের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রসঙ্গে
রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আরামদায়ক, স্বস্তিকর এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের যাতায়াতের জন্য রেল পরিবহনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। দেশে রেল যোগাযোগের সূচনা হয় ১৮৬২ সালে। প্রথমদিকে শুধু অর্থনৈতিক কাজের জন্য রেলপথ চালু করা হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামক কোম্পানি প্রথম বাংলাদেশে রেলপথ স্থাপন করে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেল যুগে প্রবেশ করে। সময়ের বিবর্তনে রেল পরিষেবাও ঘটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তনও মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। কারণ স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারগুলোর সিদ্ধান্তহীনতা, অদূরদর্শী পরিকল্পনা, দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাকে এ জন্য দায়ী করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রেল যোগাযোগে জনপ্রত্যাশার কাছাকাছি কিছু কিছু কাজ হলেও তা আবার দুর্নীতির দুষ্টক্ষত এবং অনিয়মের অভিযোগে আবৃত।
তবুও রেল পরিষেবায় আসবে গতি, আসবে নতুনত্ব, মুক্ত হবে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা ও বেড়াজাল অতিক্রম করে রেলব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন, নতুনত্ব ও আধুনিকতার ছোঁয়া পাবে। সারা দেশকে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি ঢাকাকে বৃত্তাকার রেল এবং ঢাকার সঙ্গে নিকটস্থ জেলাগুলোর মধ্যে সার্বক্ষণিক সংযোগ স্থাপনের প্রত্যাশা যাত্রীদের। আশা করছি, নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় জনপ্রত্যাশাকে গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। একই সঙ্গে রেলের চলমান প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম এগিয়ে নেবেন।
অভিযোগ উঠেছে, ব্রিটিশ আমল থেকে রেললাইন, রেলব্রিজ, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন এবং কোচ মেরামত ও সংস্কারে নেই কার্যকর উদ্যোগ ও প্রকল্প। বিভিন্ন সময়ে এসব নিয়ে পত্রিকায় তথ্যবহুল সংবাদ, সম্পাদকীয় প্রকাশিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব আমলে নেয়নি। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে রেলওয়ের উন্নয়নে বিগত ১৫ বছরে রীতিমতো প্রকল্প নেওয়ার হিড়িক পড়েছিল। নতুন নতুন প্রকল্প নিতেই বেশি আগ্রহ ছিল এ খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সচিবসহ কর্তাব্যক্তিদের। কারণ বরাদ্দ অর্থের একটি বড় অংশ যায় কর্তাদের পকেটে- এটি এক রকম ‘ওপেন সিক্রেট’ অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প ব্যয়ের ১৫ থেকে ৩৫ শতাংশ দিতে হয় মন্ত্রণালয় ও রেল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। অন্যান্য খুচরা খরচের পর দেখা যায় বাস্তবে বরাদ্দের ৫০ শতাংশ ব্যয় হয় মূল কাজে। এতে এক রকম জোড়াতালি দিয়েই সম্পন্ন হচ্ছে রেলের অধিকাংশ উন্নয়ন কাজ। আর জরাজীর্ণ রেললাইন দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই চলছে ট্রেন। ফলে লাইনচ্যুতির ঘটনাসহ ট্রেন দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।
রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিগত ১৫ বছরে রেলওয়ে উন্নয়নে ৯৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। কাগজে-কলমে এতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাস্তবায়িত অধিকাংশ প্রকল্পের মেয়াদ ২-৩ বার বৃদ্ধি করাসহ ব্যয় বেড়েছে দুই থেকে চার গুণ। ৯৫ প্রকল্পের মধ্যে জরাজীর্ণ রেলপথ, রেলওয়ে ব্রিজ, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ সংস্কারে যথাযথ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। এ সময় ক্ষমতাধর বড় কর্তারা শুধু নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে ছুটেছেন। মাঠপর্যায়ের কিংবা সরাসরি রেলওয়ে অবকাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নতুন প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, এখনো আছেন অনেকে। রেলওয়ের সাবেক এক মহাপরিচালক বলেন, জরাজীর্ণ লাইন নিয়ে মন্ত্রী, সচিবদের সামনে কথাই বলা যেত না। নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন রেলপথমন্ত্রী ও সচিবের ইশারায় হতো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি রাজনৈতিকভাবে রেলে কাজ করেছে এবং এখনো করছে। রেলপথ বিভাগের ডিজিসহ কর্মকর্তারা শুধু হুকুম মানেন। প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রকল্পের পিডিকে মন্ত্রী এবং সচিবকে ‘ম্যানেজ’ করে কাজ করতে হয়েছে। এসব প্রকল্প থেকে নির্ধারিত ‘পার্সেন্টেজ’ বা ঘুষ দিতে হয়েছে ঊর্ধ্বতনদের।
সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের মিরশ্বরাই এলাকায় তেলবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। প্রতি মাসে এমন লাইনচ্যুত, দুর্ঘটনার সংখ্যা (ছোট-বড়) প্রায় ২২ থেকে ২৫টি। গত মার্চে ২০ ঘণ্টার ব্যবধানে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ও বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্তে যাত্রীবাহী বিজয় ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়। এতে অন্তত ৭০ যাত্রী গুরুতর আহত হন। রেল কর্তৃপক্ষের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘রেলে লাইনচ্যুত কিংবা দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় সাধারণ যাত্রী নিহতসহ গুরুতর আহতও হচ্ছেন। কার্যকর অর্থে রেলপথ সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে দুর্ঘটনা কমে আসত। অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে বলেই লাইনগুলো দিন দিন আরো জরাজীর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এসব কাজের জন্য প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে রেলপথে কী পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, কী পরিমাণ কাজ করা হয়েছে, সবই খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। নতুন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঠিকাদার, বাস্তবায়নের সঙ্গে থাকা রেলপথমন্ত্রী, সচিবসহ পিডিদের আমলনামা বের করা হবে।
রেলের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রেলপথের প্রায় ৭৩ শতাংশ লাইন এবং ৭৭ শতাংশ রেল ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে বারবার ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০২৩ সালে ২৮৭টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩১৮ জন নিহত ও ২৯৫ জন গুরুতর আহত হন। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, ২০২১ সালে ৪০২টি রেল দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৯৬ জন নিহত হয়। ২০২২ সালে ৬০৬টি রেল দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হয়েছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা-লাইনচ্যুতি কমে আসছে। কিন্তু এখনো যে হারে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে, তা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সারসংক্ষেপ থেকে জানা যায়, চলমান ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে জরাজীর্ণ রেলপথ, রেলওয়ে ব্রিজ সংস্কার, টেকসই মেরামতের কোনো প্রকল্প নেই। এসব প্রকল্পে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। অধিকাংশেই মেয়াদ ও অর্থ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সমাপ্ত প্রকল্পের মধ্যে এমনো রয়েছে, শুরুতে ব্যয় ধরা ছিল ৭ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকায়।
রেলওয়ে অপারেশন, পরিবহন, রোলিং স্টক ও পরিবহন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৩ হাজার ১১৪.৬৬ কিলোমিটার রেলপথের প্রায় ৯২ শতাংশ স্থানে যথাযথ পাথর নেই। ওইসব স্থানে হুক প্লেট খোলাসহ স্লিপার নড়বড়ে রয়েছে। রেলপথে দায়িত্বরত অতিরিক্ত প্রকৌশলী বলেন, রেলপথ সংস্কার অর্থ বরাদ্দ নামেমাত্র দেওয়া হয়। গত অর্থবছরে দুই অঞ্চলে গড়ে ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতি বছর শুধু রেললাইনে ৫ শতাংশ হারে প্রায় ৯০ লাখ সিএফটি পাথর প্রয়োজন। যার মূল্য আসে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। পরিবহন দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, দুই অঞ্চলে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেই বরাদ্দের নামমাত্র কাজ করা হয়। সবই লুট হয়। লাইনে পাথর দেওয়া থেকে শুরু করে, ব্রিজ সংস্কার কিংবা অন্যান্য সংস্কারের ক্ষেত্রে- ছোটখাটো ঠিকাদারের সবাই রাজনৈতিক দলের। রেলপথমন্ত্রীর আত্মীয় কিংবা মন্ত্রীর ইশারা ছাড়া কোনো কাজই হয়নি। ২০২২ সালে ‘বঙ্গবন্ধু শতবার্ষিকী উদযাপন’ উপলক্ষে রেলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি রেলওয়ে স্টেশন মেরামত-উঁচুকরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এসব প্রকল্পের গুণগত মান দেখে, লিখিত বক্তব্য দিতে রেলের ১০ জন উপসচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বঙ্গবন্ধুর নামে যে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, এর অধিকাংশ অর্থই লুটপাট করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধার সবাই আওয়ামী লীগের ছিলেন। জানা গেছে, একজন অতিরিক্ত সচিব প্রকল্পগুলো সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। সেই অতিরিক্ত সচিব রেলপথমন্ত্রী যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই সব করেছেন। রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তর জরাজীর্ণ লাইন সংস্কারে ২০০ কোটি টাকা থেকে কিছু টাকা বরাদ্দের কথা জানালেও রেলপথমন্ত্রী ও সচিব সাড়া দেননি। রেলওয়ে রোলিং স্টক দপ্তরে দুর্নীতি পদে পদে-এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের থাকলেও সংশ্লিষ্টরা আওয়ামী রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকায় কাউকেই শাস্তি পেতে হয়নি। কেনাকাটায় লাগাতার দুর্নীতি হলেও ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রেলওয়ে প্রকৌশলী বিভাগের সাবেক এক প্রধান প্রকৌশলী জানান, গত ১৫ বছরে উচ্চগতির ইঞ্জিন ও কোচ আনা হলেও ওইসব প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি প্রকল্পে দুর্নীতি হওয়ায় দুদকে মামলাও রয়েছে। শুধু ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকায় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে ইঞ্জিন-কোচ আনা হলেও সুফল পাচ্ছেন না সাধারণ যাত্রীরা। ১২০-১৩০ কিলোমিটার গতির কোচণ্ডইঞ্জিন আনা হলেও বর্তমানে এসব কোচ, ইঞ্জিন গড়ে ৬৪ কিলোমিটার গতি নিয়ে চলাচল করছে। উচ্চমানের প্রায় ৪০টি ইঞ্জিন ক্রয় করা হলেও পূর্বাঞ্চলের আখাউড়া-সিলেটসহ রেলের বিভিন্ন সেকশনে এসব ইঞ্জিন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। শুধু জরাজীর্ণ লাইনের অজুহাতে। তা ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা ১০টি ইঞ্জিন ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। ৩২২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকায় কেনা এসব ইঞ্জিনে গতিও উঠছে না। লাইন সংস্কার না করে এমন উচ্চ মানসম্পন্ন ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়েও ছিল ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ। প্রত্যাশা থাকবে রেলকে জনবান্ধব, অধিকতর সেবাধর্মী, দেশব্যাপী রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণ, রাজধানীর জনবসতির চাপ কমাতে ঢাকার সঙ্গে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ. ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলাকে সার্বক্ষণিক রেল যোগাযোগের আওতায় আনতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি, অনিয়ম, দীর্ঘসূত্রতা, অধিক ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের লাগাম টানা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বরাদ্দ করা অর্থের কাজ সমাপ্ত করার ওপর জোর দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম
"