সমতার নীতির ভিত্তিতে হোক আন্তনদীর পানিবণ্টন
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গও একই বন্ধনিভুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই কৃষিপ্রধান। ফলে এসব দেশ পানির ওপর নির্ভরশীল। দেশগুলোর অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি করা ছাড়া পথ নেই। সে ক্ষেত্রে আন্তসীমান্ত নদীগুলোর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আছে ৫৪টি আন্তসীমান্ত নদী। এর মধ্যে ৪৩টি অভিন্ন নদীর বেশির ভাগ পানি আটকে রাখে ভারত, যেটা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ নয়। অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যে একমাত্র গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি কার্যকর হয় ১৯৯৬ সালে, যার মেয়াদ মাত্র ৩০ বছর। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিও সমান গুরুত্ব রাখে। কিন্তু এই চুক্তিতে ভূ-রাজনৈতিক রং চড়ানোয় আজও তা কার্যকর হয়নি।
তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যু আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় গঙ্গাচুক্তির পর। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মন্ত্রিপর্যায়ের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে উভয় দেশে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। ওই বছর একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্য ৩৬ শতাংশ, ভারতের জন্য ৩৯ শতাংশ এবং বাকি ২৫ শতাংশ পানি ছিল নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ১৯৮৭ সালে মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। এরপর আর কোনো চুক্তি হয়নি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। সেই চুক্তির সময়কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। ওই চুক্তি অনুসারে তিস্তা নদীর পানির ওপর ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ ভারতের এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো। তখনো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার কারণে এই চুক্তি আর সম্পন্ন হয়নি। বর্তমানে জনগণের চাহিদা বৃদ্ধি এবং বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই পানির চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি ব্যবস্থাপনা এ ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে পানিসংকট প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে।
এ অবস্থায় দুই দেশের অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করার তাগিদ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য দূর করতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতের সঙ্গে ‘কাজ করবে’ বলেও জানিয়েছেন তিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এ চুক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে, যা কোনো দেশের জন্যই ভালো হচ্ছে না।’ ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস তিস্তা চুক্তি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। ওই সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশগুলো কতটা পানি পাবে, তার সুনির্দিষ্ট অধিকার তাদের আন্তর্জাতিক আইনে দেওয়া আছে, যা সমুন্নত রাখা প্রয়োজন। পানিবণ্টনের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখার ফলে কোনো লাভ হচ্ছে না। আমি যদি জানি আমি কতটুকু পানি পাব, তাহলে সেটি আমার জন্য ভালো হবে। এমনকি পানির পরিমাণ নিয়ে আমি যদি সন্তুষ্ট নাও হই, তারপরও সেটা জানা আমার দরকার।’
আন্তসীমান্ত নদীর পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তির মাধ্যমেই একটি দেশের পানির ন্যায্য হিস্যার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হয়। তিস্তাসহ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রতিটি নদীর পানি সমতার নীতির ভিত্তিতে বণ্টন হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
"