রেজাউল করিম খান
মুক্তমত
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রশ্নে মতবিনিময়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর যে প্রশ্নটি সামনে আসছে, সেটি হচ্ছে- এ সরকারের মেয়াদ কত দিন থাকবে। বাংলাদেশের সংবিধান কিংবা কোনো আইনে এই সরকার ও এর মেয়াদ সম্পর্কে কিছুই বলা নেই। যে কারণে বিষয়টি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। ইতিমধ্যে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময় হয়েছে। সবাই স্বীকার করেছেন, শেখ হাসিনার সরকার দেশের যে ক্ষতি করে গেছে, তার কিছুটা পূরণ পুনর্গঠন ও সংস্কারের জন্য সময় প্রয়োজন। তারা এর জন্য ড. ইউনূসের সরকারকে যৌক্তিক সময় দেবেন।
বেদনাদায়ক একটি ঐতিহাসিক ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশ ও তার গুণ্ডাবাহিনী গুলি চালিয়ে এবং পিটিয়ে মাত্র ১৫ দিনে দেশের সহস্রাধিক নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে; যা পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমনটি হয়নি। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেলে দেশে শাসন বিভাগে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। অবশ্য ৮ তারিখেই নতুন সরকার শপথ গ্রহণ করে। শুরুতেই কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের দাবি উত্থাপন করে। তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। গত ৭ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে আয়োজিত এক সমাবেশে দলটির নেতারা এ দাবি জানান। সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে ছোট ছোট দলের নেতারা সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা নির্বাচনের পূর্বে পরিবেশ তৈরির জন্য এই সরকারকে যথেষ্ট সময় দিতে চান। পরে বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর তিন মাসের বেশি সময় দিতে রাজি হয়েছেন।
কেউ কেউ বলছেন, যেহেতু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান মেনে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে, সেহেতু তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানতে হবে। কিন্তু এ কথা সত্য, সংবিধান মেনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়নি। আন্দোলনের একপর্যায়ে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়ান। তারা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনার তৈরি দানব পুলিশ বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা হামলা করে আন্দোলনকারীদের ওপর। এমনই এক ভয়ংকর পরিস্থিতিতে অসম সাহসী ছাত্র-জনতা গুলি-বন্দুক-লাঠি-টিয়ার শেলের সামনে দাঁড়িয়ে যায় বুক চিতিয়ে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আবু সাইদ, মীর মুগ্ধ কিংবা অন্য কারো ছবি যারা দেখেছেন, আমার বিশ্বাস, তারা সবাই অশ্রুসিক্ত হয়েছেন।
অবশেষে ওদের রক্তের বিনিময়ে দেশ হলো স্বৈরাচারমুক্ত। এলো দ্বিতীয় স্বাধীনতা। না, একাত্তরের স্বাধীনতাকে অবহেলা বা খাটো করছি না। কিন্তু দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকালেরও অধিক সময় আমাদের না ছিল বাকস্বাধীনতা, না ছিল মৌলিক মানবাধিকার। দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ হয়েছে সীমাহীন বৈষম্যের শিকার। সাম্য-সমতাণ্ডসুবিচারের কোনো মূল্যই ছিল না শাসকগোষ্ঠীর কাছে। সাধারণ মানুষ দিন-রাত গাধার খাটুনি খেটেও জোগাড় করতে পারেনি মানসম্মন্ন খাবার, ওষুধ, স্ত্রী-সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। এমন অবস্থায় এলো ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার। এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু সরকার কি পারবে সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে?
বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান মেনে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে সংবিধান মেনে। এখন সরকারের স্থায়িত্ব ও নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য গণভোটের আয়োজন করা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক হবে না। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনরায় প্রতিফলিত হবে। সংবিধানের ১৪২(১ক) অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘গণভোট অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির নির্দেশপ্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে কমিশন সরকারি গেজেটে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করিয়া গণভোটের তারিখ নির্ধারণ করিবে : তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত তারিখ এমনভাবে নির্ধারণ করা হইবে, যাহাতে উক্ত প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ হইতে ৪০ দিনের মধ্যে গণভোট অনুষ্ঠান করা যায়।’
বাংলাদেশে তিনবার গণভোট হয়। এর মধ্যে দুবার হয় প্রশাসনিক গণভোট এবং একবার হয় সাংবিধানিক গণভোট। প্রথমে প্রশাসনিক গণভোট হয় ১৯৭৭ সালে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসন কার্যের বৈধতাদানের জন্য। দ্বিতীয়বার প্রশাসনিক গণভোট হয় ১৯৮৫ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সমর্থন যাচাইয়ের লক্ষ্যে হ্যাঁ-না ভোট। তৃতীয়বার সাংবিধানিক গণভোট হয় ১৯৯১ সালে, সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী আইন প্রস্তাব। ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে একটি সাংবিধানিক গণভোট হয়। ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কি না?’ সংশোধনীগুলো সংসদীয় সরকারের পুনঃপ্রবর্তনের দিকে পরিচালিত করবে, রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক রাষ্ট্রের প্রধান হবেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হবেন নির্বাহী প্রধান। এটি উপ-রাষ্ট্রপতির পদটিও বিলুপ্ত করে এবং সংসদ কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবে। এখন রাজনৈতিক দলের নেতা ও আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, যা ভালো মনে করেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"