মো. সাফফাত হোসেন
দৃষ্টিপাত
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তন মানেই জীবের জন্য ক্ষতিকর, তা কিন্তু নয়। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনে এর ক্ষতিকর দিকগুলোর দিকেই ইঙ্গিত করা হয়, তবুও জানা প্রয়োজন এটা কী এবং কেন।
জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশের একটি সাধারণ বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন অতীতেও হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এর পেছনে শুধু দায়ী মানুষ, তাও নয়। যখন মানুষ ছিল না, তখনো জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এত আলোচনা কেন? উত্তরে আসা যাক। মূলত, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীবের যেসব ক্ষতি হচ্ছে, তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছে। অতীতের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পৃথিবী সৃষ্টির পর তা উত্তপ্ত ছিল, তাই জলবায়ুও ছিল উত্তপ্ত, সেটি তাপ বিকিরণ করে ঠাণ্ডা হলো অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন হলো। আবার, চার কোটি বছর আগে যে বরফ যুগ শুরু হয়েছিল, তখন গোটা পৃথিবী বরফ দ্বারা আচ্ছাদিত হয়, সে সময়ও জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। আবার ডায়নোসর বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন অথচ এই তিন সময়ের কোনোটিতেই মানবসভ্যতা ছিল না। এই জলবায়ু পরিবর্তন কখনো জীবের উপকারে এসেছে আবার কখনো
জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করেছে, পার্থক্য এখানে আর ভীতির কারণও এখানেই যুক্ত।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নানা ঝুঁকির কথা প্রতিনিয়ত আলোচিত হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হচ্ছে, সভা-সেমিনার করা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী আন্দোলন করা হচ্ছে, নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন আবার এসে যায়, আদৌ এতে কোনো লাভ হচ্ছে কী? কিছু কিছু সময় তো দেখা যায়, প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি ব্যানার বা প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করুন’, পলিব্যাগে লেখা ‘পলিমুক্ত দেশ গড়ুন’সহ ইত্যাদি। অনেকটা সিগারেটের মতো, পণ্যের গায়েই এর বিপক্ষে লেখা, তবে ক্ষতির কোনো চিত্র দেওয়া নেই এই-ই পার্থক্য। প্লাস্টিকের সঙ্গে জলবায়ুর সম্পর্ক আছে, তাই এটি সর্বত্র উল্লেখ করা উচিত। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব নয়। চেষ্টা করলে এর পরিবর্তন গতি কমানো সম্ভব, ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব বা বিকল্পব্যবস্থা নিয়ে আসন্ন সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। বাংলাদেশ যতটা না জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, তার চেয়ে বেশি এর ক্ষতিকর দিকের ভুক্তভোগী হবে। যেমন : জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে পানি সমুদ্রে পতিত হবে, সমুদ্রের উচ্চতা বাড়বে ফলে দেশের নিচু অঞ্চলগুলো প্লাবিত হবে। সঙ্গে জমির উর্বরতা নষ্ট হবে। আবার একই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে খরা প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই দ্রুত শীতল হতে এসি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা রুম ঠাণ্ডা করে ঠিকই কিন্তু পরিবেশ গরম করছে বহু গুণে। অর্থাৎ ক্ষতি হচ্ছেই। কিন্তু এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে একমাত্র দায়ী কী বাংলাদেশ? না, শুধু বাংলাদেশ না। প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশ এবং উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত কিন্তু ক্ষতির শিকার অপেক্ষাকৃত নিচু ভূমির দেশ অথবা অবকাঠামোগতভাবে অনুন্নত দেশগুলো। আন্তর্জাতিক বেশ কিছু আইন এই ব্যাপারে প্রচলিত থাকলেও উন্নত দেশগুলো এই ব্যাপারে সচেতন নয় আবার ক্ষতিপূরণ দিতেও নানা গড়িমসি করছে সব সময়।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন হওয়ার মূল কারণগুলোর অন্যতম কারণ হলো কার্বন নিঃসরণ। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি- আইইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মধ্যে সবার প্রথমে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর যথাক্রমে চীন, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত। আইইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ ছিল ১৩.৩, চীনে ৮.৯, জাপানে ৮.১, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৫.৪ এবং ভারতে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ ছিল ২ টন। সেখানে বাংলাদেশে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ ছিল মাত্র ০.৬ টন (সূত্র : Bangladesh : CO2 Country Profile by Hannah Ritchie and Max Roser, 2022)। প্রসঙ্গত এই যে, এসব অধিক কার্বন নিঃসরণকারী রাষ্ট্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানো হবে বলে দাবি করা হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে তা আরো বাড়বে, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশসহ সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানিপ্রবাহ শুকনো মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে না। পাশাপাশি নদী-শাসনের কারণেও নদীগুলোর নাব্যতা নষ্ট হচ্ছে। ফলে নদীর পানির স্রোত কমে গিয়ে শূন্যতা সৃষ্টি হলে সেখান সমুদ্রের লোনাপানি ঢুকে পড়ছে, যার দরুন লবণাক্ততা সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেলের পানিসম্পদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ সমুদ্রতীরের বেশ কটি দেশে সামনের দিনে স্বাদুপানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে
নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন এবং ভূমিধসের মাত্রা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি। ব্রিটিশ
গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্র্যাফ্টের তালিকায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার আগে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। শ্বাসকষ্ট, হিটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যু কিংবা তীব্র ঠাণ্ডাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে। লবণাক্ততা সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা ছেড়ে নিকটবর্তী বড় শহরগুলোয় কিংবা রাজধানী শহরে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য আয়ের অতিরিক্ত উৎস তৈরি না হওয়ায় উদ্বাস্তু মানুষ বেছে নেয় নানা অপকর্মের পথ, শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হয় সমাজের। জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রয়োজনে বাংলাদেশকে প্রতি বাজেটে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে হয়। ফলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে করণীয় কী? করণীয় কাজের মধ্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সদিচ্ছা। সব নাগরিক একীভূত হয়ে কাজ করলে রাষ্ট্রের পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে ফসিল ব্যবহার কমাতে হবে। পরিবেশবান্ধব কলকারখানা চালু করতে হবে, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে হবে। যেটি আবশ্যক, সেটি গাছ লাগানো নয়, বরং গাছা না কেটে ফেলা এবং গাছগুলোর পরিচর্যা করা। প্রতি বছর অনেক গাছ লাগানো হয়, কিন্তু পরিচর্যার অভাবে হয় সব নষ্ট কিংবা কেটে ফেলে করা হয় পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা
"